ছোটগল্পঃ গোধূলির আলো – কৃত্তিকা ভৌমিক

গোধূলির আলো
কৃত্তিকা ভৌমিক

আজকাল বাস্তবটাকে বুঝতে শিখেছে রাতুল। বছর দুয়েক হল ইতিহাসে মাস্টার্স করে বসে আছে। এই বাজারে ইতিহাস পড়ে চাকরি পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এই সত্য হাড়েহাড়ে বুঝছে সে।
আপাতত কয়েকটা টিউশনি করছে। তাও নিচু ক্লাসের। যেটুকু টাকা পাওয়া যায়! নিজের হাত খরচ বাদ দিয়ে সবটাই দিয়ে দেয় মায়ের হাতে। হাত খরচ আর কি! নেশা টেশা কোনদিনই সে করে না। তবু সামান্য কিছু তো হাতে রাখতেই হয়।
বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে কর্মরত ছিল। গতবছর সেই চাকরি টা চলে গেছে। লকডাউনের জন্য কতভাবে যে মানুষ নিঃস্ব হয়েছে তা বলার নয়। তবে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে একটা কাঠের গোলায় হিসেবনিকেশ রাখার কাজটা জোগাড় করতে পেরেছে বাবা। নাহলে যে কি হত ভাবলেই বুক কাঁপে রাতুলের।
তিনটে মাত্র প্রাণী বাড়িতে। সে, বাবা আর মা। এতদিন খুব সুন্দর করেই সংসারটা চালাত মা।
রাতুল কোনদিনই খুব ডিমান্ডিং নয়। পোশাকাশাকের বাহুল্য তার কোনদিনই নেই। ছোট থেকে মা সেভাবেই তাকে মানুষ করেছে। তবে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে সে একটু বিলাসী, মানে খেতেটেতে বেশ ভালোবাসে এই আর কি। বাবা যতটা পেরেছে ভালো মন্দ খাইয়েছে বরাবর । তবে ইদানীং সেটাতে একটু ঘাটতি পড়েছে।
মা যদিও বুঝতে দিতে চায় না সেকথা। বেশ সুচারু হাতে, দক্ষ ড্রাইভারের মতো সরু গলি-ঘুপচি দিয়েও সংসার নামক গাড়িটা চালানোর চেষ্টা করে। এটুকুই স্বস্তির।
বাড়ির গেট খুলে বেরিয়েই রাস্তায় লাল্টুর সাথে দেখা। লাল্টু জিজ্ঞেস করল-
, ‘কোথায় যাচ্ছিস রাতুল? খবর রাখিস কিছু?
লাল্টুর প্রথম প্রশ্নের উত্তরটাই দেয় রাতুল।
‘যাব একটু বাজারের দিকে। বিকাশের দোকানে একটা জেরক্স করতে দেওয়া আছে। সেটা নিয়ে ওখান থেকে টিউশন পড়াতে চলে যাব’
লাল্টু তার সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। একইসাথে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে তারা। এখন তার মতই বেকার।
রাতুল ইচ্ছে করেই লাল্টুর দ্বিতীয় প্রশ্নের ধার দিয়ে গেল না।
এখন খবর শোনা মানেই হয় কারও মৃত্যু সংবাদ অথবা তার ক্রিটিকাল কন্ডিশন। আর নেওয়া যাচ্ছে না।
‘আসি রে লাল্টু’ বলে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতেই লাল্টুর পরের কথাটা কানে এল, ‘তৃণাদের বাড়িতে চল্ একবার।’
তৃণা!!!
এই নামে এখনও এত শিহরণ!! সেই কবে থেকে একটাই নামের অনুরণন রাতুলের হৃদয়ে।
যখন তারা সবে মাধ্যমিক পাশ করে ক্লাস ইলেভেন। আগে পড়ত বয়েজ স্কুলে। মাধ্যমিক পাশের পর ইলেভেনে ভর্তি হয় কোএডুকেশন স্কুলে। সেখানেই সহপাঠী ছিল তারা। রাতুল, লাল্টু, বিকাশ, অরুণাংশু, সাহানা, অন্বেষা আর তৃণা ।
প্রথম প্রথম বয়েজ স্কুল থেকে আসা ছেলেদের গ্রুপটাই একসাথে থাকত। পরে যখন পার্থ স্যারের কাছে ইংরাজি পড়তে যেত তখন ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয় মেয়েগুলোর সাথে।
ক্লাসেই রাতুল চোরা চোখে দেখত তৃণাকে। একটু শ্যামলা রঙ। চোখ দুটো ভীষণ মায়াময়। যেন শান্ত দিঘির জল। বয়স আন্দাজে একটু যেন গম্ভীর প্রকৃতির। তবে আজ বলতে বাধা নেই প্রথম দর্শনেই মেয়েটার প্রেমে পড়েছিল রাতুল। তবে সে প্রেমের কথা বলব বলব করেও বলা হয়ে উঠছিল না।
তৃণার শান্ত চোখ দুটোর দিকে তাকালে সব কেমন গোলমাল হয়ে যেত রাতুলের। টিউশন পড়া আর স্কুল এই ছিল রাতুলের ধ্যানজ্ঞান তখন। তবু পড়াশোনা চলছিল ঠিকঠাক।
নদীর উপরে যে নতুন ব্রিজ হয়েছে সেটা পেরিয়েই বাঁ হাতে তৃণাদের বাড়ি। রাতুলদের বাড়ি ব্রিজের এপারে। স্যারের কাছে পড়া শেষ করে রাতুল আর লাল্টু তৃণাকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে তবেই বাড়ি ফিরত।
লাল্টু আর সে একই পাড়ার ছেলে তাই সবসময়ই একসাথে। তৃণাকে কখনও বলার সুযোগ হয়নি রাতুলের যে সে তৃণাকে ভালোবাসে। শুধু সব বন্ধুদের মাঝে বারে বারে তৃণাকে দেখার মধ্যে যে ভালোলাগা, সেটুকু ছিল শুধু রাতুলের নিজস্ব।
রাতুল বুঝতে পারত না যে, সব বন্ধুদের মধ্যেও তার জন্য তৃণার মনেও আলাদা কিছু অনুভূতি ছিল কি না!! তবু তৃণাকে ভালোবাসার কথা বলার জন্য সে ছটফট করত।
এভাবেই শেষ হয় তাদের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। মফস্বল কলেজেই ভর্তি হয় তারা। অরুনাংশু আর সাহানা পড়তে চলে যায় কলকাতায়। অন্বেষা চলে যায় নার্সিং পড়তে ভুবনেশ্বর।
টিম টা ছোট হয়ে আসলেও তারা বেশ ভালোই ছিল পড়াশোনা, কলেজে আড্ডা, গান গল্প সব নিয়ে।
অনার্স সাবজেক্ট আলাদা হওয়ার জন্য তাদের ক্লাসের সময়ও আলাদা হয়ে যায়। তবু অন্যান্য কিছু সাবজেক্ট একই সাথে ক্লাস হয়।
তৃণা বাংলায় অনার্স। ছোট থেকেই ইতিহাস রাতুলের খুব প্রিয় বিষয়। সে ইতিহাস নিয়ে অনেকদূর পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখে। এভাবেই চলতে থাকে নিজের গতিতে জীবন।
রাতুলের প্রেম যেখানে ছিল সেখান থেকে একটুও এগোতে পারে নি। তার অস্বস্তি হোক বা সহবত, যে কোন কারণেই হোক সে তৃণার কাছে নিজের প্রেম ব্যক্ত করতে পারে নি।
থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে। দিনটা ছিল শনিবার। প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান । সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততা ও আনন্দে কেটেছিল।
আজও মনে আছে রাতুলের। অনুষ্ঠান শেষ করার পর সে তৃণাকে একান্তে পেয়ে গিয়েছিল হঠাৎই।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল তৃণা। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় হলুদ শাড়ির আড়ালে সেই শ্যামলী মেয়েটাকে যেন অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। গোধূলির আলো তৃণার শরীরটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল।
রাতুল ফিসফিস করে ডেকেছিল ‘তৃণা’
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে রাতুলের সামনে দাঁড়িয়ে তৃণা বলেছিল, ‘কিছু বলবি রাতুল?’
একদম ইতস্তত না করেই রাতুল বলে ফেলেছিল তার মনের কথা।
‘আমি তোকে ভালোবাসি তৃণা।’ এক বুক ভালোবাসা নিয়ে তৃণার সামনে দাঁড়িয়েছিল সে।
সেই পড়ন্ত আলোর আভা তার খুব কাছে এসে বলেছিল, ‘আমিও তো তোকে ভালোবাসি রাতুল। তুই আমার খুব ভালো বন্ধু।’
তৃণার কাছে ঘন হয়ে এসে রাতুল বলেছিল, ‘আমি তোর সাথে সারাজীবন থাকতে চাই তৃণা।’
জবাবে তৃণা বলেছিল, ‘কিন্তু আমি তো তা চাই না।’
তাকে আলোছায়ায় ফেলে রেখে সেই গোধূলির আলো ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিল।
সিঁড়ির সেই আধো অন্ধকারে ফাঁকা ক্লাস ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রাতুল দেখেছিল তার মায়াময় ভালোবাসা চলে যাচ্ছে তাকে একা করে দিয়ে।
সেই ঘটনার পর ফাইনাল পরীক্ষার স্টাডি লিভ শুরু হয়ে যায় রাতুলের। তারপর পাশ করে সে ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে চলে গিয়েছিল। আর কোনদিন সে তৃণার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নি।
মফস্বল ছোট একটা শহর তাদের। একই শহরে থাকার দরুন কখনও হয়ত দুজনের চকিতে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু তেমনভাবে আর কথা তাদের হয়নি। রাতুল আজও জানে না তৃণা কি অন্য কাউকে ভালোবেসেছে!!
লাল্টু তার খুব কাছের বন্ধু হয়েও এই বিষয়ে রাতুলের কাছে কিছু জানতে চায়নি। তৃণাও তো লাল্টুর বন্ধু হয়ত সে কিছু বলে থাকবে। বন্ধু যাতে মনে কষ্ট না পায় তাই হয়ত লাল্টু ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে।
লাল্টুর কথায় সম্বিত ফিরল রাতুলের। সে জিজ্ঞেস করল ‘তৃণাদের বাড়িতে যাব কেন!!’
লাল্টু বলল ‘আগে চল বলছি’
সেদিন তৃণা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ রাতুল সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ভেবেছিল হয়ত তৃণা ফিরে আসবে। কিন্তু কেউ ফিরে আসেনি।
একরাশ অভিমান বুকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল রাতুল। এখনও তার মন ধিকিধিকি পোড়ে। মনখারাপ করা বাদল দিনের মতো তারও মন জুড়ে থাকে কষ্টের মেঘ।
নতুন ব্রিজ পেরিয়ে তৃণাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তারা দুই বন্ধু।
আজ বিকেলেও সেই সেদিনের মতন তেমনই গোধূলি আলো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তৃণা। কিন্তু সেই শ্যামলী মেয়েটার উজ্জ্বল আভা কে কেড়ে নিল!!
প্লাস্টিকের চাদরের মোড়কে শরীর ঢেকে তৃণা চলেছে অজানার পথে।
রাতুল তীব্র ভালোবাসায় খুঁজে চলেছে সেই গোধূলির আলো। যে আলোর দিকে চেয়ে চেয়ে সে ভেবেছিল হয়ত সে আবার ফিরে আসবে!

                            --------------------

10 thoughts on “ছোটগল্পঃ গোধূলির আলো – কৃত্তিকা ভৌমিক

  1. বাহ্।খুব ভালো লাগলো। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তীতে।

  2. দারুণ লেখা। শব্দের স্ফুটন খুব ভালো।

      1. চমৎকার গল্পটি। শেষটায় মনটা ভারাক্রান্ত হল।

  3. চমৎকার গল্পটি। শেষটায় মনটা ভারাক্রান্ত হল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *