বিপ্লবী পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি: কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিপ্লবী পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি:
কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছিনা। তিনি শতবর্ষ পার করেছিলেন একথা সত্যি, কিন্তু তাঁর অকস্মাৎ চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিনা কিছুতেই।
শিবপুর ও হাওড়ার অন্যান্য অঞ্চলের আমরা বেশ কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী অখিল ভারতীয় ভাষা সাহিত্য সম্মেলন, পশ্চিমবঙ্গশাখার সদস্য হয়েছিলাম।সম্ভবত 1990 সালে শিবপুর বি ই কলেজে জাতীয় সম্মেলন হল, বিশাল আয়োজন করে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে এলেন অনেক অতিথি। দুই-তিনদিন ধরে চলল নানা অনুষ্ঠান। যে কজন এই বিশাল আয়োজনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। তখনই দেখি পূর্ণেন্দুবাবুকে। জানলাম তিনি এই সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গশাখার প্রতিষ্ঠাতা। অত মানুষের ভিড়ে সেইভাবে তাঁর সঙ্গে তখন পরিচয় হয়নি।পরের বছরও বেশ বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল কলকাতায়। 1992 সালের একত্রিশে মে প্রথম পূর্ণেন্দুবাবুর বরানগরের বাড়িতে আমি যাই; সেদিন সংস্হার একটি সভা ছিল তাঁর বাড়িতে। তারপর নানা অনুষ্ঠানে ওনার সঙ্গে দেখা হয়, কথাও হয়। জানতে পারলাম তিনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কিন্তু তিনি সব সময়ই আমাদের সকলকে নিয়েই চলতেন।
2008 সালের জুন মাসে সংস্হার জাতীয় সম্মেলন ভূপালে। একজন সঙ্গী পেলে পূর্ণেন্দুবাবু ভৃপাল যাবেন। আমার দাদা কৌশিক তখন পশ্চিমবঙ্গ শাখার সম্পাদক।পূর্ণেন্দুবাবু তাকেই সঙ্গী হিসেবে চাইছিলেন। কিন্তু আমার দাদার পক্ষে নানা কারণে সেই সময় যাওয়া সম্ভব না হওয়ায়, আমিই গেলাম পূর্ণেন্দুবাবুর সঙ্গে।তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ার কারণে ট্রেনে তাঁর এবং তাঁর একজন সঙ্গীর টিকিটের খরচ লাগেনা। ট্রেনে যাবার সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কার নানা কথা শুনতে শুনতে গেলাম। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ট্রেনের অন্য কামরায় ছিলেন আমাদের সংস্হার সদস্য অধ্যাপক কবি সত্যপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। ভূপালে আমরা কটা দিন খুব আনন্দে কাটালাম। শহরটাও ঘুরে দেখলাম একদিন। একদিন সাঁচি স্তূপ গেলাম। তখন পূর্ণেন্দুবাবুর বয়স প্রায় অষ্টআশি, কিন্তু তিনি আমাদের মত নবীনদের সঙ্গে যেন নবীনই হয়ে গিয়েছিলেন। কোথাও তাঁর পান্ডিত্যের প্রকাশ দেখিনি, দেখিনি নিজের সম্বন্ধে কিছু বলা। জানিনা তাঁর এই বর্ণময় সংগ্রামী জীবনের স্মৃতিকথা তিনি লিখেছেন কিনা। বছরে একবার সংস্হার সাধারণ সভায় তাঁর সঙ্গে দেখা হত। তাঁর ভাষণ দিয়েই শুরু হত আমাদের সভার। অফিসে কাজের চাপে ও নানা ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে পূর্ণেন্দুবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ বেশ কমে গিয়েছিল।

শহীদ ভগৎ সিংহের মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে , ২০১৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর।

দু হাজার উনিশ সালের আঠাশে সেপ্টেম্বর শিবপুর কাজীপাড়ার মোড়ে শহীদ ভগৎ সিংহের একটি মূর্তি বসানো হবে। মূর্তি উন্মোচন করার জন্য আগষ্ট মাসের এক সকালে আমি গেলাম তাঁর বাড়ি। অনেকগুলো বছর কেটে গেছে ইতিমধ্যে। তখন তিনি নিরানব্বই। তখনো প্রকাশ করে চলেছেন তাঁর পত্রিকাটি। আমাকে একটি কপি দিলেন। আমি আমার সম্পাদিত বিশিষ্ট আলোকচিত্রশিল্পী রামানন্দ সেনগুপ্তর স্মৃতিকথা ‘ছায়াছবির ছায়াপথে’ বইটি তাঁর হাতে তুলে দিলাম। শহীদ ভগৎ সিংহের মূর্তি উন্মোচনের জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম। একটু চিন্তা ছিল, এই বয়সে তিনি বরানগর থেকে শিবপুর আসতে রাজি হবেন কিনা। কিন্তু তিনি তখনো আগের মতই প্রাণবন্ত, রাজি হলেন এবং সেই অনুষ্ঠানে অসাধারণ বক্তব্য রেখেছিলেন, যার কিছুটা আমি রেকর্ড করেছি।
পূর্ণেন্দুবাবুর থেকে শোনা তাঁর জীবনের দুটি ঘটনা আপনাদের জানাই।1942 সালে মৈমনসিংহ থেকে বি এ পাস করে পূর্ণেন্দু কলকাতায় এলেন এম এ পড়তে। থাকতেন শিয়ালদহের কাছে এক মেসে। লেখালিখির সূত্রে অনেকের কাছেই তিনি তখন পরিচিত। একদিন এক প্রবীণ কবি এক কিশোরকে নিয়ে এলেন পূর্ণেন্দুর মেসে। কিশোরটির পরণে মলিন ধুতি ও শার্ট, খালি পা। খুবই শান্ত প্রকৃতির ছেলেটির নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য। বহরমপুরে এক কবি সম্মেলনে কবিতা পড়তে যেতে হবে পূর্ণেন্দুকে, সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে এই কিশোর কবিকে। প্রবীণ কবি আলাপ করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। পূর্ণেন্দুর বয়স তখন আনুমানিক পঁচিশ বছর ও সুকান্তর উনিশ। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর সুকান্তকে বাসে তুলে দেবার সময় পূর্ণেন্দু তাঁর এই বয়সে ছোট বন্ধুটিকে একটি জুতোর দোকানে নিয়ে গিয়ে জোর করে একজোড়া চটি কিনে দিলেন আর বললেন, “কবি সম্মলেনে যাবার দিন ভালো ধুতি আর শার্ট পরে আসবেন।” পূর্ণেন্দুর কথা মতই সুকান্ত এসেছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে ট্রেনে করে বহরমপুর গেলেন। যাবার সময় সুকান্ত তাঁর কবিতাগুলো পূর্ণেন্দুকে পড়তে দিয়ে মতামত চাইলেন। পূর্ণেন্দু কবিতাগুলো পড়ে কয়েকটি অভিমত দিলেন এবং সুকান্ত পূর্ণেন্দুর অভিমতগুলো গ্রহণ করে কবিতায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনও করলেন।

সম্ভবত 1928-1929 সাল। তখন পূর্ণেন্দু বালক, থাকেন মৈমনসিংহে। কিন্তু তখন থেকেই বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। কাউকে বলতেন বড়দা, কাউকে মেজদা, কাউকে ছোড়দা। প্রকৃত নাম জানা যেতনা কোন বিপ্লবীদের। এমনই এক দাদার থেকে নির্দেশ এল; একটি সেতুর ওপরে পূর্ণেন্দুকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এক যুবক এসে পূর্ণেন্দুকে জিজ্ঞেস করবেন, ” তোমার কাছে দেশলাই আছে।” তার উত্তরে পূর্ণেন্দুকে জবাব দিতে হবে, ” দেশলাই আছে কিন্তু কাঠি নেই।” সেই যুবক উত্তরে বলবেন, “ঠিক আছে চলবে।” পূর্ণেন্দুকে বিপ্লবী দাদার নির্দেশ ছিল, ” তুমি কখনো পেছনে তাকাবেনা, কোথাও দাঁড়াবেনা, নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যাবে; এটাই তোমার দায়িত্ব। সেই লোক তোমাকে ঠিক অনুসরণ করবে।” ঘটনা ঠিক তেমনই ঘটেছিল, যেমনটি বলা ছিল।
অনেক বছর পর, ভারত তখন বৃটিশ শাসন মুক্ত। পূর্ণেন্দু তখন কম্যুনিষ্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। একদিন পত্রিকার দপ্তরে এক ভদ্রলোক এলেন, অনেকের সঙ্গে কথা বার্তা বলার ফাঁকে পূর্ণেন্দুর দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর সেই ভদ্রলোক হেসে পূর্ণেন্দুকে বললেন, “চিনি চিনি মনে হচ্ছে।” পূর্ণেন্দুও হেসে জবাব দিলেন, ” আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি; আপনি বিপ্লবী গণেশ ঘোষ। মৈমনসিংহের সেতুর ওপর থেকে আমিই সেদিন আপনাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।”

এমন অনেক ঘটনা আছে পূর্ণেন্দুবাবুর জীবনে। খুব ইচ্ছে ছিল, তাঁর অমূল্য অভিজ্ঞতাগুলো রেকর্ড করব, কিন্তু তা আর হলনা। এই দূঃখ আমার কোনদিনও যাবেনা।

6 thoughts on “বিপ্লবী পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি: কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. এই স্মৃতিচারণ শেষ হওয়ার নয়। আরও অনেক জানার আশায় রইলাম ।

  2. কি সুন্দর স্মৃতিচারণ। আরও জানতে ইচ্ছে করছে।

  3. অসাধারণ, স্মৃতিচারণা। আরো জানার অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *