শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের আধ্যাত্মিক ভাবনা – ভূমিকা গোস্বামী

শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের আধ্যাত্মিক ভাবনা
ভূমিকা গোস্বামী

শত বসন্ত পার করলেও প্রতি নিয়ত বদলে যাওয়া প্রকৃতির সৌন্দর্য নতুন করে উপলব্ধি করতেন তিনি। “এ আর নতুন কি! কতবার তো দেখেছি” – এমন কথা কখনও শুনি নি তাঁর মুখে।
অসম্ভব পরিশ্রমী একজন মানুষ ছিলেন । পরিশ্রম বিমুখতা তাঁর না পসন্দ।
শেষ প্রায় একটি বছর চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। তখনও তিনি লিখে গেছেন তাঁর অনুভবের কথা। প্রতিটি শব্দের শেষে আঙুলের এক কর ফাঁক দিয়ে আরেকটি শব্দ লিখেছেন। এভাবে খাতার পর খাতা শেষ করেছেন। কয়েক মাস আগেও বিভিন্ন সভা সমিতিতে গিয়েছেন।
এই বয়সেও তিনি দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতেন । যাঁর কণ্ঠ মাইকের তোয়াক্কা না করে তাঁর বলা প্রতিটি শব্দ হলের শেষ মানুষটির কান পর্যন্ত পৌঁছোত- তিনি পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য। তাঁর আধ্যাত্মিক ভাষণ যাঁরা শুনেছেন তাঁরা জানেন। একটা পিন পড়ার আওয়াজও তখন হত না। সকলে যেন কান দিয়ে পান করতেন তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান রস।
জ্ঞানী মানুষ সচরাচর ব্রহ্ম জ্ঞানের কথা সাধারনের সাথে আলোচনা করেন না। তিনি কিন্তু সহজ করে ভারতীয় দর্শনের গূঢ় কথাগুলো বুঝিয়ে বলতেন।
তিনি বলতেন – প্রতিটি জীব , এমনকি জড় বস্তুর মধ্যেও ঈশ্বর আছেন। ঈশা বাস্যম্ ইদং সর্বম্। প্রতিটি ধূলি কণার মধ্যেও তিনি আছেন। পরমেশ্বর চিৎঘন। জীব চিৎকণ।
বলতেন– চারতলা বাড়ির মতো আমাদের এই শরীর। দেহের উর্ধ্বে প্রাণ। প্রাণের উর্ধ্বে মন। মনের উর্ধ্বে চেতন স্তর। নিজের চিন্তনের উর্ধ্বগতি মানুষকে চেতনায় উর্ত্তীর্ণ করে।
একদিন আমি ঘরের কাজ করতে করতে গান করছি। প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা বলছি।..”..আমার যতই দু হাত ভরে উঠুক ধনে। তবু তোমায় ঘরে হয়নি আনা সে কথা রয় মনে। যেন ভুলে না যাই , বেদনা পাই শয়নে স্বপনে।”
আমার ছোট ছেলে অনিন্দ্য তখন বছর দশেকের। ও হঠাৎ প্রশ্ন করল- কাকে ঘরে আনা হয় নি মা ?- আমি বললাম— আমাদের সবথেকে আপনজন ভগবানকে বাবা।

তুমিতো বল এই সবকিছু ভগবান তৈরী করেছেন। তা হলে , সেখানে ভগবান কিকরে থাকবেন ?
কঠিন প্রশ্ন। আমার সেই বয়সে উত্তর জানা ছিল না।
আমি বাবাকে বললাম। বাবা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন আমার বালক পুত্রকে।
বললেন-ছোটভাই দেখ, যখন কিছুই ছিলনা তখনও তিনি ছিলেন। তিনি ইচ্ছে করলেন জগত সৃষ্টি করবেন। কিন্তু সৃষ্টি করতে তো উপাদান লাগে। কিন্তু কিছুই তো নেই, উপাদান কোথায় পাবেন ! কি দিয়ে সৃষ্টি করবেন ! তাই নিজেকেই উপাদান করে সৃষ্টি করলেন। তাই সৃষ্টির মধ্যেও তিনি। সৃষ্টির বাইরেও তিনি। বলতেন- ওঁ রূপে হৃদয় দেবতা সকলের মধ্যে আছেন। সৎ রূপে জগতে আছেন। আর তৎ রূপে তিনি পরমাত্মা পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর। তিনে এক। একে তিন। আবার বলতেন – সৎমা বলে না? যে মা কে দেখা যাচ্ছে সে সৎমা। আমরা এই জগৎ কে দেখতে পাচ্ছি । এই জগতে তিনি তাই সৎ রূপে আছেন। হরি – ওঁ তৎ সৎ রূপে এভাবেই আছেন।
আমার ছোট ছেলে তো খুশি হয়ে গেল। বাবা এলে ছাড়তে চাইত না আমার ছেলেমেয়েরা। যতক্ষণ থাকতেন আধ্যাত্মিক কথায় ডুবে থাকতো ওরা। আমি সংসারের কাজে থাকলেও কান থাকতো এই আলোচনায়। বাসে তুলে দিতে যেতাম । সেই সময়টুকুতেও তাঁর কথা শুনতাম। ফেরার সময় ছেলেরা বলতো — আঃ আজ অনেক রোজগার হল।
এভাবেই ওদের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে সমৃদ্ধ করেছেন ওদের।
আমাকে বলতেন , ধ্যান করবি। ঈশ্বরের কোন মূর্তি যদি ধ্যান করতে না পারিস। যে কোন রং ধ্যান করিস।
শত বর্ষ পার হলেও তাঁর প্রভাব শরীরে দেখা যায় নি । কোন বলিরেখা ছিল না। জানি না এটা ধ্যানের ফল কি না।
বলতেন – প্রতিটি জন্মের একটা উদ্দেশ্য থাকে। কোন জন্ম ই অকারণে নয়।
প্রতিটি মানুষ আলাদা। এমনকি একই গাছের প্রতিটি পাতা আলাদা।
আমাকে একবার বললেন, গীতার দ্বাদশ অধ্যায় মুখস্থ কর।(কোথায় যেন কমপিটিশান ছিল )সংস্কৃত উচ্চারণ- তিনটি স -এর , ণ এর, য এর । ধরে ধরে শিখিয়ে দিলেন। আমি মুখস্ত করে ফেললাম। কিন্তু আর কেউ নাম না দেওয়ায় অনুষ্ঠান টি বাতিল হয়ে যায়। আমার কিন্তু ততদিনে গীতার মহা মূল্যবান কথাগুলোয় নেশা ধরে গেছে। আমি আজও সেই নেশায় বুঁদ হয়ে আছি। মনন করতে করতে এক একটি শ্লোকের তালা খুলে যেতে লাগল আমার কাছে। বাবাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি । আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করেছি। বাবা খুশি হতেন। বলতেন — এটাই হয়। গীতা পড়লে, মনন করলে তিনি স্বয়ং সহজ করে বুঝিয়ে দেন।

বছর পনের আগে ব্যাঙ্গালোরে ( IISC) আমার ছোটপুত্রের ঘরে বাবা, মা, আমি, আমার ছোটপুত্র, আমার স্বামী আমার বড় পুত্রের তোলা ছবিতে


আমার তিনটি সন্তানকেই বাবা সংস্কৃত শিখতে পাঠিয়েছিলেন। দুই ছেলেকে ডুমুর দহে, মেয়েকে দিল্লীর অরবিন্দ ভবনে। দশদিনের ওয়ার্কশপ। ওরা সংস্কৃততে কথা বলতে পারতো।
আমার স্বামীর চোখের অপারেশন করাতে ছ’বার চেন্নাই এর শংকর নেত্রালয়ে যেতে হয়েছিল। বাবা যেতেন আমাদের সাথে। এক একবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে যেতে হয়েছে। কখনও থাকার জন্য ইউথ হস্টেলের ঘর ফাঁকা নেই বলে পাই নি। ডরমিটরিতে তিনজনের কোনও রকম ব্যবস্থা করা গেছে। আমি অসহায় বোধ করতাম । বাবাকে এই নিয়ে বললে , বাবা বলতেন — বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ভাববি আমার জন্য কোন কিছুই অনুকূল হবে না। কোনও আশা করবি না। মনে করবি প্রয়োজনে রাস্তায় থাকতে হতে পারে। এরপর যা কিছু ভাল হবে তা ঈশ্বরের দান মনে করবি। না পেলে নতুন করে কষ্ট পাবি না। সত্যিই, আমি বাবার কথা পরীক্ষা করে দেখেছি। আকাঙ্খা ই দুঃখের কারণ।
মনটা তাঁর ছিল শিশুর মতো। সকলের সাথে মিশতে পারতেন। বাচ্চাদের সঙ্গেও খুব মজা করে কথা বলতেন। ” বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্ ” সেটা যারা তাঁর কাছাকাছি এসেছে তারা জানেন। সকলের ভাবনা কে মূল্য দিতেন। মনোযোগ দিয়ে সকলের কথা শুনতেন। প্রতিনিয়ত শিখতেন।
একবার মোক্ষ লাভ নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি বললাম, – প্রীতির সাথে ধর্ম , নীতির সাথে অর্থ রোজগার , আর রীতির সাথে জীবন যাপন করলেই তো তাহলে মোক্ষ লাভ হয়ে যায়। তাই না বাবা ? বাবা খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন — সুন্দর আর সহজ করে বললি। ঠিক কথা।

আমার বড় পিশেমশাই মারা যাওয়ার পর বড় পিশি কি খাবে , কি পরবে এই নিয়ে
আলোচনায় বাবা বলেছিলেন – তুই বিয়ের পর যা যা গ্রহণ করেছিস যেমন শাঁখা ও সিঁদুর সেটা ত্যাগ করবি। বিয়ের আগের তোর পোষাক এবং আহার ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। পিশি বলেছিলেন দাদা পাপ হবে না তো ? বাবা ধমকে বলেছিলেন – যা বলছি তাই করবি।পাপ হলে আমার হবে। মেয়েদের কষ্ট দেয়ার নিয়ম এগুলো। পালন করতে হবে না।
তাঁর ধমক যারা খেয়েছে তারা আরও বেশী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাঁর কাছাকাছি যারা এসেছেন তারা আমার সাথে একমত হবেন ।
তিনি প্রত্যেকের ভেতর থেকে সেরার প্রকাশ দেখতে চাইতেন। যোগ্যতা আছে কিন্তু অলস কারণে কিছুই করছে না। এটা তিনি মানতে পারতেন না। ক্ষেপে যেতেন।
রাধা কে তিনি কৃষ্ণের আরাধ্যা বলতেন। -” আমার বুকে কৃষ্ণ কাঁদে রাধে রাধে ওঁ রাধে।” “দেহি পদপল্লভ মুদারম্ ” উঠতে যদি ব্যর্থ হই, তোমার চরণ আমার মই।
তাঁর বিখ্যাত কবিতা “রাধাকেই চাই ” কবিতায় তিনি বলতে চেয়েছেন আমরা শুধু ঘর ও ঘরনী নিয়ে তৃপ্ত নই। আমরা রাধাকেই চাই। কেউ অর্থে , কেউ যশে, তাঁকে খোঁজে। কিন্তু পাওয়ার পর
দেখে, রাধা তখনও বহু দূরে। আপনাদের জন্য কবিতাটি নিচে দিয়ে দিলাম-

কেবল কৃষ্ণ ই নন, তুমি আমি প্রত্যেকেই
সুন্দরী রুক্মিনী নিয়ে
ঘর ও ঘরণী নিয়ে তৃপ্ত নই,-
আরো কিছু হয়ে উঠতে চাই
ফুটে উঠতে চাই
সে ভবিতব্যের নাম রাধা।
কেবল কৃষ্ণই নন, তুমি আমি প্রত্যেকেই
সুন্দরী রুক্মিনী নিয়ে তুষ্ট নই
যা নই তা হতে চাই, রাধাকেই চাই।

কেউ বা পয়সার শব্দে শোনে তার নূপুরের বোল।
নোটে শোনে শাড়ী ভাঁজ পরার আওয়াজ
সোনার মধ্যেই সেই কাঞ্চন বরনীকে খোঁজে।
হায়রে তাদের অভিসার
সেখানে পৌঁছে দেখে
রাধা আছে আরো বহুদূর।

কেউ তার চিঠি খোঁজে মানপত্রে, খ্যাতির দলিলে।
বরণ মালায় দেখে কণ্ঠলগ্ন তার আলিঙ্গন।
সেইসব পেয়ে আরো পেয়ে
দেখে তারা রাধা বহুদূর।

যা নই তা হতে চাই, অথচ হয়েই আছি নিজের গভীরে।
সে মানস সুন্দরীরই অন্য নাম রাধা।
আমার নিঃশ্বাস তবে হোক তার নাম – সাধা বাঁশি।
তার রঙে আমি তবে বসন রাঙাই
পীতাম্বর হই।

6 thoughts on “শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের আধ্যাত্মিক ভাবনা – ভূমিকা গোস্বামী

  1. মন ভরে পড়লাম । আরও জানার ইচ্ছে রইলো ।

  2. কি ভালো লাগল! আপনি তো ভাগ্যবতী। এমন একজন মানুষের কন্যা আপনি!

  3. এই স্মৃতি চারণাকে অনুসরণ করে চলে গিয়েছিলাম শৈশবে। এমন আরো লেখা পড়বো আশা রাখি।

  4. অপূর্ব মূল্যায়ন। সুন্দর স্মৃতি চারণ। লেখিকার হৃদয়ের খোঁজ পাওয়া গেলো‌।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *