সম্পাদকীয়ঃ মন্দিরা গাঙ্গুলী

সম্পাদকীয়ঃ ২২ শে মে, ২০২১

প্রকাশিত হল অবেক্ষণ পত্রিকার ২২শে মে, ২০২১ এর সংখ্যা। সমস্ত লেখক, কবি এবং শিল্পীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। পত্রিকার সমস্ত পাঠকের জন্য রইলো অকৃত্রিম শুভেচ্ছা।
আমরা অত্যন্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করছি। প্রিয়জন, বন্ধু, প্রতিবেশীকে হারিয়ে ফেলছি মারণ ভাইরাসের সংক্রমণে। মন ভালো নেই কারোরই। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি রোগমুক্ত দিনের। এর মধ্যেও আমাদের ভালো থাকতে হবে, সুস্থ থাকার জন্য মন ভালো রাখা জরুরি। সকলে নিজেদের মন ভালো রাখুন। সাহিত্য প্রেমী মানুষের কাছে
সাহিত্য চর্চাই একমাত্র মন ভালো রাখার উপায়। ভালোবেসে পড়ুন ভালোবেসে লিখুন।
আমাদের কাছে অনেক লেখা জমা হয়, ইচ্ছে থাকলেও সবার লেখা অথবা সবার সব লেখা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। যাঁরা অবেক্ষণ পত্রিকায় লিখতে চান বা লেখেন সবাইকে অনুরোধ করব আগে পত্রিকা পড়ুন, জানুন পত্রিকার লেখার মান। বেশ কিছু নামী লেখকের লেখা আমরা প্রকাশ করতে পারিনি আবার একদম নতুন লিখছে এমন লেখকের লেখাও জায়গা করে নিয়েছে অবেক্ষণ পত্রিকায়।
যাঁরা পত্রিকায় লিখেছেন অনুরোধ করব, বাকি লেখক, কবির রচিত সাহিত্য পাঠ করুন, মতামত দিন। আপনিও তো চান, আপনার লেখা বাকিরা পড়ুক।
ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখক দের কিছু উপদেশ দিয়ে গেছেন। নিজের জন্য পড়ছিলাম, মনে হল সমস্ত লেখকের কাছে আজও প্রাসঙ্গিক। তাই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।
“বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ ১। যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে। ২। টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়; লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোক-রঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে। ৩। যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দৰ্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে। ৪ । যাহা অসত্য, ধৰ্ম্ম বিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থ সাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্ৰবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ। ৫। যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছ, কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকৰ্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্য্যে ব্ৰতী, তাঁহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর। ৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপণ অকৰ্ত্তব্য। এটি সোজা কথা, কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না। ৭ । বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে, তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর, এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাশি, জর্মান কোটেশন বড় বেশী দেখিতে পাই। যে ভাষা। আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না। ৮ । অলঙ্কার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে ; লেখকের ভান্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে।–ভান্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভান্ডারে অলঙ্কার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মত কদৰ্য্য আর কিছুই নাই। ৯ । যে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাটিয়া দিবে, এটি প্রাচীন বিধি। আমি সে কথা বলি না। কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভাল না হইয়া থাকে, তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভাল লাগিবে না-বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দিবে। ১০ । সকল অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কেন না, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝানো। ১১। কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না।”

সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নমস্কার।

10 thoughts on “সম্পাদকীয়ঃ মন্দিরা গাঙ্গুলী

  1. এই জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র কে সাহিত্য সম্রাট বলা হয়। সুন্দর সাবলীল সম্পাদকীয়।

    1. একদমই তাই সঙ্গে আর দুটো কথা যোগ করা উচিত ছিল, – অপ্রিয় ও বলিষ্ঠ। সম্পাদক ( আমি লিঙ্গভেদ করি না) এই কথা গুলো বলে অনেকের কাছে হয়তো বা অপ্রিয় হলেন। আর এমন সোজাসাপ্টা (বলিষ্ঠ) লিখতে গেলে কব্জির জোর লাগে। আমি কুর্নিশ করলাম এমন সম্পাদক কে।

  2. অসাধারণ সম্পাদকীয়। এই সম্পাদকীয়র কথা গুলো মেনে চলতে চেষ্টা করলে দেখা যাবে এক দিন লেখক নিজের অজান্তেই এক ভরসার জবরদস্ত লেখক হয়ে উঠেছেন। সমাজ সংসার তাঁর কাছ থেকে নিজ নিজ প্রয়োজনীয় পেয়ে যাবেন। নির্মল জল আর বাতাস দিয়ে ভরে থাকবে প্রকৃতি , সুস্থ মন দিয়ে সাহিত্য জগতের পরিমণ্ডল গড়তে থাকবে।

    1. খুব ভালো লাগল সম্পাদকীয় লেখাটা। মনখারাপের মধ্যে ই এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। আরও একবার তোমাকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা জানাই। খুব ভালো থেকো।

    2. সাহিত্যসম্রাটের দামী কথাগুলো তুলে ধরলেন।

    3. অসাধারণ লাগলো সম্পাদকীয়। বঙ্কিমচন্দ্রের যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাতে সমৃদ্ধ হবে পাঠকমন।
      কাহার অনুকরণ করিও না। নবীন লেখকদের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের কি অসাধারণ কথা!
      এই ধরনের সম্পাদকীয় সব পাঠকদের পড়া উচিত। ভালো থাকবেন।

  3. সুন্দর সম্পাদকীয়। বঙ্কিম চন্দ্রের অনেক পরামর্শই আজও প্রাসঙ্গিক। তবে অর্থের বিনিময়েও উৎকৃষ্ট সাহিত্য হয়, বাঙলা সাহিত্যে তার উদাহরণ অনেক। আবার সুযোগ্য লেখক তাঁর উৎককর্ষতার আর্থিক মূল্য না পেয়ে পুরো পুরি সাহিত্যকর্মে মন দিতে পারেন নি। উপার্জনের জন্য অনেক সমঝোতা করতে হয়েছে। আবার যাঁরা জেদ করে লেখাটাই চালিয়ে গেছেন তাঁদের জীবন শেষ হয়েছে অভাবে অপমানে, বিনা চিকিৎসায়। কাজেই ‘যোগ্যতমের জয়’ কথাটা শিল্প সাহিত্যে সব সময় বলা যায় না। আর কিছু মানুষ দ্রুত নাম করার তাগিদে নিজের লেখা ফেলে রেখে দেবার কথা ভাবতেই পারেন না। আর এই নাম করার দৌড়ে কী কী হয় বা যশোপ্রার্থীরা কী কী করেন তা ভিড় থেকে সরে দাঁড়ানো লেখকরা এবং বুদ্ধিমান পাঠক পাঠিকারাও জানেন। তবে মানো আর না মানো ঋষি বাণী অসার তো হতে পারেনা।

  4. ভীষণই জোরালো সম্পাদকীয়। মাননীয়া আপনি এই কথা গুলো বলে হয়তো অনেকের কাছে হয়তো বা অপ্রিয় হলেন। আর এমন সোজাসাপ্টা (বলিষ্ঠ) লিখতে গেলে কব্জির জোর লাগে। আমার বিশ্বাস আপনি সঠিক পথেই চলেছেন কারণ এই লেখা গুলো তিনিই লিখতে পারেন যিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, কারণ তিনি জানেন যে এই কথা গুলো লিখলে তিনি অনেকের অপ্রিয় হয়ে উঠবেন। বঙ্কিম বাবু কে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন আনন্দে থাকবেন।

  5. খুব সুন্দর সম্পাদকীয় পড়লাম। সাহিত্য সম্রাটের কথাগুলি সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানাই সম্পাদককে। পত্রিকার জন্য রইল অশেষ শুভকামনা।

Leave a Reply to krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *