সাম্প্রতিক ১৯ঃ ভোট ভিক্ষে কেন ! – অনিরুদ্ধ সুব্রত


ভোট ভিক্ষে কেন !
অনিরুদ্ধ সুব্রত

রবীন্দ্রনাথ তার ‘অসন্তোষের কারণ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “ছোটোর উপকার করিতে হইলে বড় হইলে চলে না ছোট হইতে হয়।”
আসন্ন নির্বাচন প্রাক্কালে আমাদের জননেতাদর বোধ করি রবীন্দ্রনাথের কথাটি বেশ মনে লেগেছে। কেননা শুধুমাত্র ভোট চাইতে গিয়ে কখনো কখনো ভোটে দাঁড়ানো মানুষটি বড় বেশি ছোট হয়ে যাচ্ছেন। ভোটাদের কাছে ভোট ভিক্ষে করা কেন ? আপনি তো রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব নিতে চলেছেন। জনকল্যাণ আপনার লক্ষ্য। সুতরাং আপনি মহান, দায়িত্বশীল,কর্তব্যপরায়ণ তথা সুযোগ্যতা সম্পন্ন। মানুষ আপনার যোগ্যতা ও নিষ্ঠা দেখে শাসন ক্ষমতা তুলে দেবে আপনার হাতে। আপনি হবেন আত্মসম্মান ও সম্ভ্রমের মূর্তি। ক্ষমতা ভিক্ষা আপনাকে কীভাবে মানায় !
শাসনতন্ত্র চালানোর জন্য যে প্রতিনিধি হ‌ওয়ার সুযোগ তারা চাইছেন, তাতে রীতিমতো ভোট ভিক্ষা করার সুর তাদের গলায় শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে যিনি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার একজন দায়িত্বশীল মানুষ হয়ে উঠবেন, তার চরিত্রে এত দৈন্যতা কেন।
ভারতীয় ইতিহাসের অতি প্রাচীন কালে যখন গ্রিক দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার ভারতীয় আঞ্চলিক রাজা বন্দি পুরু কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি আলেকজান্ডারের কাছ থেকে কেমন ব্যবহার আশা করেন । তখন পুরু কিন্তু বলেছিল রাজার প্রতি রাজার ব্যবহার। অর্থাৎ যত ক্ষুদ্রই হন একজন রাজা বা রাজ ক্ষমতার প্রতিনিধি, একটা নিজস্ব সম্ভ্রম প্রত্যাশিত, বা তার ব্যবহারে সম্ভ্রমের ছোঁয়া থাকাটা স্বাভাবিক। মানে এই আত্মসম্মান ও বিপরীত পক্ষে সম্মান দেখানো, এটাই রাজ ক্ষমতার ছোট-বড় প্রত্যেক প্রতিনিধির অন্যতম সামাজিক কর্তব্য‌ও।
আজ হয়তো শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয় বদলে গেছে সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার মডেল। কালের নিয়মে এবং মানুষের চাহিদায় বা বলা যায়, শিক্ষায় ও সচেতনতায় অধিকাংশ রাষ্ট্র কোন‌ও না কোন‌ও ভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর সাধারণ মানুষের জনপ্রতিনিধিত্ব স্বীকার করেছে। কিন্তু তাই বলে রাজ ক্ষমতার রাজকীয়তা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। বিশেষ করে যখন সেটা রুচি ও সম্মানের প্রশ্ন।
আজকের দিনে সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার যারা রাজ্য বা দেশের আইনসভা ভরাবেন বলে মানুষের কাছে বক্তব্য রাখছেন তাদের লক্ষ্য হয়ত আপামর মানুষের সমর্থন পাওয়া। কেননা সাধারণ মানুষ কখনোই জনপ্রতিনিধি কে হবেন, তাকে বাড়ি থেকে ডেকে আনে না। আমরা যে গণতান্ত্রিক সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সেখানে একাধিক রাজনৈতিক দল তাদের তাদের মনোনীত প্রার্থীকে একেকটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে দাঁড় করান ।এবং তার সম্পর্কে মানুষের কাছে প্রচার চালান, মানুষ সেই প্রচার শোনে এবং সেই ব্যক্তির বক্তব্য শুনে তারপর তাকে নির্দিষ্ট দিনে ভোটবাক্সে সমর্থন জানায়।
সুতরাং ভোট প্রচার মানেই ভোটে দাঁড়ানো ব্যক্তির আচার-ব্যবহার, বক্তব্য ,সম্মানবোধ, সম্ভ্রম, রুচি এবং অন্যান্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত চেতনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছুই খেয়াল করে না,তাই নয়। অবশ্য এই সাধারন মানুষ কতটা সাধারণ এবং কতখানি রাজনৈতিক আফিমের নেশায় আছেন সেটাও বিবেচ্য। তবুও অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রার্থীর সম্পর্কে বা তার আচরণ সম্পর্কে অথবা জ্ঞান ও মেধা সম্পর্কে জানতে চায়। তাই বলে ভারতবর্ষের মতো দেশে সমস্ত প্রার্থীরাই উচ্চশিক্ষিত উচ্চমেধা সম্পন্ন হবেন, এমন আশাও কেউ করেন না। কিন্তু তাদের আচরণে যেমন বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহার প্রত্যাশা করা হয়, তেমনি প্রার্থীদের আত্মসম্মানবোধ যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।
অথচ প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিটি ভোট প্রার্থীকে প্রায় বিনা ট্রেনিং এ ছেড়ে দেওয়া হয় নাগরিকদের ভোট প্রার্থনা করতে। তাই না হলে এতো আজগুবি তথ্য,তত্ত্ব এবং তেমন খুশি বক্তৃতা তারা রাখেন কীভাবে। এমনকি যারা তুলনামূলক বরিষ্ঠ নেতা, অর্থাৎ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক লড়াইয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইতিমধ্যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন তারাও। যখন জনগণের সামনে ভোট প্রার্থনা করতে গিয়ে বিশাল বিশাল জনসভায় বিরাট বিরাট মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে বক্তৃতার পাহাড় তুলে ধরছেন, তখন বক্তব্যের ভাষা বক্তব্যের প্রসঙ্গ তথ্য এবং ভোট চাওয়ার ভঙ্গিতে আত্মসম্মানের ছিঁটে ফোঁটাও থাকছেনা। সবেতেই রীতিমতো ভিক্ষা পাত্র হাতে জনগণের কাছে এক একটি ভোট ভিক্ষা চাইছেন। কিন্তু ভোট তো ভিক্ষার বস্তু নয়।
বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বলা অভিযোগ বা নিন্দায় অসম্মান করার অভ্যাস মোটামুটি এই গণতান্ত্রিক পীঠস্থান এ মেনে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু ভোট চাইতে গিয়ে ভিক্ষে ?
গণতন্ত্র এ জনপ্রতিনিধি পদ প্রার্থীর ভিখারী সাজার ভূমিকাটি মোটেও সুখকর নয়। সাধারণত যোগ্যতা, সততা, নৈতিক শিক্ষা,ও জনগণের বিশ্বাস জাগানোর মতো কোন‌ও গুণ না থাকলেই মানুষ হয় কেড়ে নেয়, নয় তো ভিক্ষা চায
ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের বয়স ব্রিটিশ পর্ব ধরলে প্রায় শতবর্ষ ছুঁতে চলল। তবু প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে এই অযোগ্য ভোট প্রার্থীরাই সবচেয়ে এগিয়ে। এই বিষয়ে এমন কোনও একটিও রাজনৈতিক দল নেই, যারা হলপ করে বলতে পারে, সম্ভ্রম, সম্মান, সুরুচি পূর্ণ ব্যক্তিরাই একমাত্র ভোটে দাঁড়ানোর জন্য টিকিট পাবে।
বরং হয় মস্তান নয় ভিখারীর সংখ্যা বেশি।
আজকের রাজনৈতিক রাজক্ষমতা আসলেই এক প্রকার জেনে বুঝে মিথ্যের সঙ্গে সহবাস। তাই দেশীয় বা আন্তর্জাতিক রাজ শক্তি ও তার ক্ষমতা দখলের হাজার মিথ এই দেশে রাষ্ট্রবিদ্যায় থাকলেও বাস্তবে মেলে না। বরং সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিনয়ে এখানে মঞ্চ ভরায়। রাজা হয়ে রাজ্য পরিচালনার সাধ আছে পুরোপুরি, নেই শুধু রাজকীয় আভিজাত্যের ছোঁয়া। অথচ ভোটে জিতে জাতির ভাষা , শিল্প , সংস্কৃতির তারাই রক্ষক ও ভবিষ্যৎ। ভাবতে অবাক লাগে কিনা, ভোট দেবার আগে সাধারণের ভাবার সময় কবে আসবে জানিনা।

One thought on “সাম্প্রতিক ১৯ঃ ভোট ভিক্ষে কেন ! – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. আমার মনের কথা। ভোটে যাঁঁরা দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা জনগণের সেবক। কে সেবার দায়িত্ব পাবেন তার জন্য খুনোখুনি, ব্যক্তি গত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির প্রয়োজন পড়ছে কেন ? নাকি এর পিছনের গল্পটা অন্য ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *