মুক্তগদ্যঃ একটি বালকের গল্প ও একটি ভাষার স্বীকৃতির আখ্যান – আইজাক সাহা

একটি বালকের গল্প ও একটি ভাষার স্বীকৃতির আখ্যান
আইজাক সাহা


সেই এক বালকবেলায় উনুনের আঁচে তখন হয়তো রাতের ভাত সবে বসিয়েছে মা। অন্যান্য জরুরী কাজও সারা। ভাত ফুটে না ওঠা অবধি একটুখানি ছোট্ট অবসরের মধ্যেই সে তার ছেলেটির অক্ষরজ্ঞান করিয়ে নিতে চায়। তাই সে এসে বসে বালকটির পাশে। চকখড়ি দিয়ে দুই আঙুলের মধ্য দিয়ে চেপে কালো স্লেটের ওপর দাগ ঘুরিয়ে বলে, সরে অ। আর বালকটি আনাড়ী হাতে মায়ের দেখানো পথে চক ঘুরিয়ে একটি অর্ধবৃত্তাকার দাগ টেনে মায়ের বলবার অব্যবহিত পরেই বলে ওঠে, সরে অ।
বলে সে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। দাগটি মায়ের মনোমত হল কিনা সে ঔৎসুক্যে ওর চোখমুখ জ্বলজ্বল করে। মায়ের মুখ দেখে সে আশ্বস্ত হয়। আবার সে দাগ কাটা ছবিটিকে দেখে। এই ছবিটি মা তাকে দিয়ে রোজ আঁকায়। ছবিটির নাম ‘সরে অ।’ আরো ছবি আঁকায় মা তাকে দিয়ে। ‘সরে অ’ যেমন তেমনই ‘সরে আ’, ‘রস্যি’, ‘দিরঘি’ এইরকম। কিছুক্ষণ পর মা স্লেটের সব দাগ ভেজা কাপড়ের টুকরো দিয়ে মুছে ফেলে বলবে লেখ,সরে অ,সরে আ, রস্যি,দীরঘি এইসব। আর বালকটি এভাবে তার অজান্তেই একটি ভাষার লিপিসমূহ আয়ত্ত করে।
বালকটি জানে না যে সে একটি ভাষা শিক্ষা করছে। ভাষাটি বাংলা ভাষা। সে এও জানে না যে তার জন্মের অনেক আগে এই ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়ে গিয়েছে। সে পরে বড় হয়ে, অনেক বড় হয়ে জেনেছে যে অনেক মানুষ এই ভাষাটির জন্যই শহীদ হয়েছেন। এই ভাষাটির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ হল তাদের প্রিয় মাতৃভাষা। ভাষাটি বাংলাভাষা।
উৎস সন্ধানে বালকটি

বালকটির ঔৎসুক্য খুব। মায়ের কোলে বসে যে ভাষার লিপি আয়ত্ত করার কৌশল শিখেছিল সেই কৌশলে সে পারদর্শী হয়ে উঠল অচিরেই। এইভাবেই সে এই ভাষাটির বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়। এই লিপিটির উৎপত্তি,লিপিটির আধার যে ভাষা সেই ভাষাটির উৎপত্তি, তার গড়ন, চলন, বিবর্তন এইসব বিষয়েও। কিন্তু সে আশ্চর্য হল এই জেনে যে এই যে তার মাতৃভাষা,প্রিয় বাংলাভাষা, এই ভাষাটির জন্য, ভাষাটির অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার জন্য তারই পাশের দেশ বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মর্যাদা অর্জন করেছে। যদিও সেসময় বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ।
এভাবেই সে ইতিহাসের হাত ধরে।
স্বীকৃতির আখ্যান

বাংলাভাষার বিশেষত্ব এই যে ভাষাটি বাংলার জলবায়ুর মতই সুমিষ্ট। ভাষা সংগঠনের যে বিশেষ কার্যকরী প্রক্রিয়া তা হল মন,সেই মন বাংলার সরস ভূমিজ সংস্পর্শে এত সরস ও মধুর। বাংলার মানুষের ভাব প্রকাশের স্বরধ্বনি বা ভাওয়েল তাই সুমিষ্ট। এই ভূমিজ ঐতিহ্যগত ও স্বাভাবিক ভাষাকে সরিয়ে উর্দু,আরবী বা ফারসী ভাষাকে প্রধান সরকারী ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার যে চেষ্টা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ভাষা আন্দোলন।
কেন এই ভাষা আন্দোলন?
বালকটি এখন আর বালক নেই। সে এখন ভাষা টির মর্মের সাথে বসবাস করে। ভাষাটির দুঃখে সে কাতর হয়। ভাষাটির অপব্যবহারে সে ক্লিষ্ট হয়। পৃথিবীর কত কোটি মানুষের মাতৃভাষা তারই মাতৃভাষা। প্রতিদিন সে অনুভব করে কিভাবে তার এই ভাষা লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে বাংলাভাষীদেরই হাতে। যে ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন। কেন তারা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য শহীদ হলেন তার অনুসন্ধানে তাই সে আবার ইতিহাসের হাত ধরে।
একদা সামন্তশ্রেণীর মুসলমানরা বাংলাভাষা ব্যবহার করতে চাইতেন না। মোগল আমল এবং ইংরেজ আমলেও এই উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা ফরাসী ও উর্দুভাষায় কথা বলতেন।জাতিগতভাবে তারা নিজেদের মনে করতেন আরব,ইরাণী,তুর্কি,খুরাসানী বা সমরকন্দী। তাই বৈদেশিক ভাষা,জাতিগত রক্তের গৌরব, ধর্ম, সামন্ততান্ত্রিক ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীস্বার্থের তাগিদে তারা বাংলাভাষা ও বাংলা সংস্কৃতিকে পরিহার করতে চাইলেন। এর ফলে উনিশ শতকের রেনেসাঁয় তাদের কোনো আত্মিক সম্পর্ক যেমন গড়ে তুলতে পারল না তেমন ধর্মচর্চা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাকে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহ ও উদ্যোগের অন্ত রইল না। তারা সমাজের উচ্চবিত্ত,উচ্চমধ্যবিত্ত হবার দরুণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলেও প্রকৃত অবস্থা ছিল এই যে বাংলার মুসলমানদের ওই নগন্য অংশ ছাড়া সব মুসলমানেরা আদতে এই বাংলার অধিবাসী এবং হিন্দু। ফলে এই বঙ্গভূমিকেই তারা স্বদেশ হিসেবে ভেবেছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আপন মনে করেছে। বাংলাভাষা তাদের মাতৃভাষা হিসেবে জেনেছে এবং আত্মস্থ করেছে। অপরদিকে নিজেদের উচ্চ পর্যায়ে উন্নত করবার স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য,সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য মিথ্যা বংশতালিকা করে আরব,ইরাণ প্রভৃতি দেশের সাথে ধর্মমতের যোগস্থাপনের মধ্য দিয়ে একদল মুসলমান স্বদেশের সাথে আত্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন হল।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার পর এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ গুরুতর আকার ধারন করে। উর্দু না জানলে কোনো মুসলমান সদ্বংশজাত বলে মনে করত না। বাংলাভাষা যে মাতৃভাষা তা স্বীকার করতে নিজেদের সামাজিকভাবে মর্যাদাহীন মনে করত। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনই সর্বপ্রথম বাঙালী মুসলমান সমস্ত সংস্কারকে দূরে ঠেলে,উর্দুকে দূরে ঠেলে বাংলাভাষাকে নিজের মাতৃভাষা হিসেবে বরণ করে নিল। ‘মাতৃভাষা রূপ খনি পূর্ণ মনিজালে’, এই সত্য অনুধাবন করল। বাংলাভাষা নিয়ে হিন্দুদের আত্মিকতা ছিলই। কিন্তু ধর্মীয় কারণে গোঁড়া উর্দুপন্থী মুসলমানদের পথে না গিয়ে বাংলাভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে বরণ করে নেওয়া আসলে মুসলমান ধর্মাবলম্বীর বাঙালীত্বে উত্তরণ। বাঙালী মুসলমান হয়ে উঠলো মুসলমান বাঙালী।
কিন্তু ভাষা নিয়ে এই দ্বন্দ্বের পেছনে আরো অনেক দ্বন্দ্ব কাজ করেছে। তা দুই পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশও বলা যায়। ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব পুরোনো। ভারত স্বাধীনের অনেক আগে থেকেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে এই দ্বন্দ্ব আর নিছক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব রইল না। তা পুরোপুরি পরিবর্তিত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে। পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা হরফ পরিবর্তনের ডাক দেন। বাংলা ভাষা থেকে বাংলা হরফ বাদ দিয়ে সে জায়গায় আরবী হরফ ব্যবহার করবার প্রস্তাব দেন। যেহেতু বাংলা হরফ দেবনাগরী থেকে সৃষ্ট ফলত সেই হরফ হিন্দু। কিন্তু হরফ পরিবর্তন এবং এমনকি বিজ্ঞানের নামে রোমান হরফে পরিবর্তনের,রাষ্ট্রভাষা উর্দু চালু করবার বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালে ছাত্ররা এবং শিক্ষিত সমাজ রুখে দাঁড়ায়। শুরু হল পূর্ব বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
কিন্তু আবার ১৯৪৯ সালে মৌলানা আকরাম খানের সভাপতিত্বে পূর্ববাংলা সরকার যে ভাষা কমিটি গঠন করে তার অন্যতম বিচার্য ছিল হরফ সংস্কার। ১৯৫০ সালে সেই কমিটি রিপোর্ট দাখিল করলেও সরকার তা চেপে রাখে। সেই রিপোর্ট পরে প্রকাশিত হলে জানা যায় যে তা বাংলাভাষা চর্চার মূলগত ভাবে বিরোধী। ১৯৪৭ সাল থেকেই বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার প্রতি আক্রমণ অব্যহত ছিল। তারই ফলশ্রুতি হিসেবেই দানা বাঁধে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। বালকটি সে আন্দোলনের বিষয়ে অবগত হয়। অবগত হতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল এর স্বতস্ফূর্ততা। তা ছিল আবেগে ভরপুর, বিস্ময়কর একটি অপ্রত্যাশিত আন্দোলন। তার ব্যাপকতা,তীব্রতা এতটাই ছিল তা পূর্বেকার সমস্ত আন্দোলনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ২১শে ফেব্রুয়ারীর পুলিশি অত্যাচার,গুলিচালনা ও ছাত্রহত্যার নিরিখে তা বিচার্য নয়। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে এর চেয়েও চরম পুলিশি নির্যাতন হয়েছে। ১৯৫০ সালে রাজশাহীতে কেন্দ্রীয় কারাগারে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার রাজবন্দীদের ওপর পুলিশ নৃশংস গুলি চালায়। কিন্তু তাতে দেশে কোনো ব্যপক আন্দোলন হয় নি। কোনো সংগঠিত বিক্ষোভও নয়। নাচোলে ইলা মিত্রের ওপর কৃষক আন্দোলনের সময়েও সরকার নির্মম অত্যাচার করেছে। কিন্তু সেজন্য অন্য স্থানের কৃষক বা মধ্যবিত্ত সমাজে কোন প্রভাব ফেলেনি তেমন। সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ পর্যন্ত হয় নি। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন বিশেষ ক্ষোভ বা প্রতিবাদও হয় নি। এমনকি ঢাকাতে জনগন সে সময় সেই বিক্ষোভ আন্দোলনের বিরুদ্ধতাও করেছে। কিন্তু ১৯৫২ সালের এই স্বতস্ফূর্তার কারন অনেকটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক।
স্বাধীনতার আগে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের যে ছবি দেখিয়েছিল অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের কাছে,তার স্বরূপ রূঢ়ভাবে প্রকাশ পেয়েছিলে। তারা নিজের দেশেই নিজেদের পরবাসী অনুভব করতে থাকল। পূর্বপাকিস্তান যে উপনিবেশ,এমন মনে হল। তারা যেন পশ্চিম পাকিস্তানের দাস। শোষণ,বঞ্চনায় ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হচ্ছিল। এই ক্ষোভ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীর মনে ক্রমশ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। তাতে ঘৃতাহুতি পড়ল প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা। আদতে এই ঘোষণা ছাত্র ও জনগনের কাছে প্রতিভাত হল শুধু রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা নয় বরং এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেখল শোষণ,প্রভূত্ব,বঞ্চনা,নিপীড়ন। তাদের যে মানসসংস্কৃতি বঙ্গভূম আর বাংলাভাষাকে ঘিরে লালিত তার বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ল। শুরু হল ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। আর এই আন্দোলন শুধু ছাত্রসমাজ ও কিছু শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না তা পরিণত হল জনগণের গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক আন্দোলনে।
তারপরের ইতিহাস সকলের জানা।১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভাঙার সেই মিছিল আর তাতে পুলিশের গুলি এবং ছাত্রদের শহীদ হবার ইতিহাস। যার হাত ধরেই এই দিনটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

One thought on “মুক্তগদ্যঃ একটি বালকের গল্প ও একটি ভাষার স্বীকৃতির আখ্যান – আইজাক সাহা

Leave a Reply to শুভ্রকান্তি মজুমদার Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *