ভাষা দিবসের কথা
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)
ইউনেস্কোর প্রতি বাংলা ভাষী মানুষের কৃতজ্ঞতা থাকবে চিরকাল, কেননা ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর এই একূশে ফেব্রুয়ারি দিন টিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” ঘোষণা দ্বারা সারা পৃথিবীর জন্য ভাষা দিবস বলে আখ্যায়িত করেছেন। সারা বিশ্বের সব কটি দেশের মানুষ সাড়ম্বরে পালন করবে মাতৃভাষা দিবস । সেইজন্য বাংলাভাষী মানুষের কাছে এর চাইতে বড় গর্বের আর কীইবা হতে পারে ? গত শতাব্দীর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী। রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি, মাতৃভাষার জন্য বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন ভাষা আন্দোলনের বীর পুরুষরা। তাঁদের রক্তে .রঞ্জিত হয়েছে এ ধরণীর মাটি।
‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/
আমি কি ভুলিতে পারি ?’ (আব্দুল গফ্ফর চৌধুরী)
না, ভাই ভোলার নয়। মনে আছে অনেকটা, সবটা তো আমাদের জানাও হয়নি। দীর্ঘ সে ইতিহাস, বক্ষের উষ্ণ শোনিতে কর্দমাক্ত সে পথ। সন্তানের রক্ত দেখেছেন এই ধরণী, এই মাটি বারবার। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের নিপীড়ন অত্যাচার আর নৃশংসতায় স্বাধীনতাকামী সন্তানরা বারবার রক্তাক্ত হয়ে মায়ের কোলে বইয়ে দিয়েছেন শোনিতধারা। দেশব্যাপী সহিংস ও অহিংস আন্দোলনের শেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট ভারত ভাগ করে পাকিস্তান আর ১৫ই আগস্ট ভারত দুটি আলাদা দেশের সৃষ্টি, হল। পাকিস্তান আবার পশ্চিম অংশে পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব অংশে পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানে দেশভাগের পর থেকেই শুরু হয়েছিল ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই। কেননা সমগ্র পাকিস্তানের তৎকালীন লোকসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশর বেশী লোকসংখ্যার ভাষা বাংলা।অথচ ঐ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা বাংলাকে দেওয়া তো হয়ই বরং ” পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোনো প্রদেশের কোন অধিবাসীরই ‘ উর্দু ‘ মাতৃভাষা নয়। – – – বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন। যেমন – পুষ্ তু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী আর বাংলা। – –
তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। “
(দৈনিক আজাদ ১২ ই শ্রাবণ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ – ‘ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা ‘ প্রবন্ধে ডঃ মহঃ শহীদুল্লাহ)
কিন্তু, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষরা এমনতরো আন্দোলন করেন নি যে, পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের বাংলা ভাষা বলতে হবে। তাঁদের দাবী ছিল বাংলা অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হোক। পাকিস্তান গঠিত হবার পর সরকারি কাগজপত্র ও মুদ্রায় শুধু ইংরেজী ও উর্দু ব্যবহার করা হতে লাগল। এই সময় পাক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এগিয়ে এসে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে এবং আরবী হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ করে বিতর্কের সূত্রপাত করেন। শুরু হল টানাপোড়েন। দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় ভাষা সংক্রান্ত সরকারি অনিচ্ছাকৃত ভুলের আলোচনায় মন্তব্য করা হোল – – – পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের মাতৃভাষা ও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার অস্তিত্বের কথা যাঁরা এইভাবে বারবার ‘ ” ” ভুলিয়া ” যাইতে পারেন, তাঁদের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানকে একদিন ভুলিয়া যাওয়া বিচিত্র নয়।
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ফজলুল হক হলের সাহিত্য সভার পর তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে সর্বপ্রথম ” রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ” গঠিত হয়।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই এই পরিষদ বাংলা ভাষার দাবীজ্ঞাপক একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠান।
কিছুদিন পর সিলেটের মুন্সীবাজার ইউনিয়নে জমিয়তে উলেমায় ইসলামের একটি সাধারণ গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় – পাকিস্তান অর্জনে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।সমস্ত পাকিস্তানের ২/৩ অংশ বাংলা ভাষাভাষী । সুতরাং গণনীতির দিক দিয়া সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু, পশ্চিম পাকিস্তানবাসীর পক্ষে অল্প সময়ে বাংলা শিক্ষা সহজ নহে বিধায় বিশেষ বিবেচনা স্থলে তথাকার রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং পশ্চিমের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা, তৃতীয় ভাষা ইংরেজি এবং পূর্বের দ্বিতীয় ভাষা উর্দু, তৃতীয় ভাষা ইংরেজি হওয়া উচিত।”
প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনে শুধুমাত্র শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহলই যুক্ত থাকতেন। কয়েক দিন পর আসাম প্রদেশ থেকে কেটে নেয়া সিলেটের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা যেমন মহিলা মুসলিম লীগের জেলা কমিটির সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সহ-সভানেত্রী সৈয়দ শাহের বানু, সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন এবং সিলেট রাজকীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী রাবেয়া খাতুন প্রমুখ তৎকালীন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের কাছে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়ে স্মারকলিপি পাঠান। সাপ্তাহিক ” নওবেলালে ” ১১ মার্চ সংখ্যায় এই মহিলাদের দাবী সমর্থন করা হয়। পক্ষে এগিয়ে আসেন তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাশেম। উল্লেখ্য, বাংলা ভাষার দাবীতে প্রথম সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস পত্রিকারই উদ্যোগে। ভাষা সংগ্রামকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণে তাঁদের ও ইত্তেহাদ পত্রিকা জোরালো ভাবে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবী প্রচার করতে থাকে।
ভাষা আন্দোলন, ভাষার জন্য, পৃথিবীর অন্যতম মিষ্টি ভাষা বাংলার জন্য। ভাষার সঙ্গে ধর্মের কোনো বৈরীতা নেই। ধর্ম বিশ্বাস ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বাংলা ভাষার সপক্ষে তাই মুসলিম হিন্দু নির্বিশেষে বাংলাভাষীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে গেছেন।
১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দুটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন, এক – অন্তত ঢাকায় বছরে একবার অধিবেশন, দুই – বাংলা ভাষাকে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে গণ পরিষদের ভাষা রূপে সমান মর্যাদা দিতে হবে।
গণপরিষদের বাংলাবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ, ইনজিনীয়ারিং কলেজ ও ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট ও মিছিল করেন।
মুসলিম লীগ, তমদ্দুন মজলিস ও কয়েকটি ছাত্রাবাসের ছাত্রদের উদ্যোগে ২ রা মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হক হলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের আহূত সভায় কমরুদ্দীন আহমেদ, রণেন দাশগুপ্ত, আজিজ আহমদ, কাজী গোলাম মহবুব, অজিত গুহ, আবুল কাশেম, সরদার ফজলুল করিম, সামসুদ্দিন আহমদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, তফজুল আলী, আলী আহমেদ, মহীউদ্দীন, আনোয়ারা খাতুন, সামসুল আলম, শওকত আলী, আউয়াল, মহঃ তোয়াহা, আলী আহাদ, শামসুল হক, শহীদুল্লাহ কয়সর, লিলি খান, তাজ উদ্দীন আহমদ প্রমুখ জনেরা ১১ ই মার্চের ধর্মঘটের পরিকল্পনা করেন।
অন্য দিকে অত্যাচার উৎপীড়ন সঙ্গে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাড়তেই থাকে। গুন্ডারা প্রশাসনের ইন্ধনে এখানে সেখানে ভাষা আন্দোলনের সভায় তাণ্ডব চালায় নির্বিচারে। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুণ্ডারা লাঠি পেটা করে। মুসলিম হল ইউনিয়নের সম্পাদক এবং তমদ্দুন মজলিসের কর্মী মোহম্মদ সিদ্দিকুল্লা কসাইটুলাতে ইস্তাহার ছাপতে গিয়ে আক্রান্ত হন।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কাজী গোলাম মাহবুব ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কাছে গুণ্ডাদের হাতে নিগৃহীত হন।
রাজসাহীতে পূর্ণ হরতালের পর ভুবন পার্কে কলেজের ছাত্ররা সভার শেষে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগান লেখা ব্যাজ বিক্রি করেন।
যশোরের প্রতিটি স্কুলে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ১১ই মার্চ পূর্ণ হরতাল পালন করেন, বাধ্য করেন একটি গার্লস স্কুলের ছাত্রীদেরকেও।
১১ ই মার্চের হরতাল বানচালের জন্য সরকার পক্ষের পুলিশ ও গুন্ডা বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জানা যায়, ঐদিন আহত হন ২০০ জন, গুরুতর আহত হন ১৮ জন আর পাকড়াও করা হয় প্রায় ৯০০ জনকে।
পুলিশ ও গুন্ডা বাহিনীর জঘন্য ভাবে অত্যাচারের প্রতিবাদে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে সভা হয়, সেখানে বিরোধীরা শতাধিক গুন্ডাবাহিনী পাঠিয়ে সভা পণ্ড করতে সচেষ্ট হয়। প্রহৃত হন জনাতিনেক নেতৃবৃন্দ, যাঁঁদের মধ্যে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান মি, দাশগুপ্ত অন্যতম।
এবার থেকে আর পুলিশ নয়, সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা হয় আন্দোলন দমন করার জন্য। ফলে, ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা দিন দিন বাড়তে থাকলো। নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী এবং আরো অনেকেই।
১৯৪৮ সালের ১১ ই মার্চ যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৫২র ২১ শে ফেব্রুয়ারি তা চরম আকার নিয়েছিল। সালাম, রফিক, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান শফিক, আউয়াল, এক কিশোর, এম এর ছাত্র বরকতদের রক্তে রাজধানী ঢাকার রাস্তা লাল হয়ে গিয়েছিল। শহীদ হলেন অনেকেই। চলছিল মুক্তি যুদ্ধ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর রাজাকারদের কুকীর্তির সামনে বুক পেতে দিয়ে শুধু মাতৃভাষার জন্য সমগ্র বাংলাদেশের দেশমাতৃকার বক্ষে বয়েছে সন্তানের শোণিতধারা। বাংলা ভাষার জন্য যুদ্ধ। যুদ্ধ চলল পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে। এগিয়ে গেল এপাড়ের সহযোগিতার হাত। চলছিল যুদ্ধ । একদিকে পাকিস্তানের সশস্ত্র সামরিক বাহিনী অন্য দিকে পূর্ব বঙ্গের তরতাজা তরুণ তরুণীর দল, বিশ্বাস তাঁদের জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনা হীন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মুক্তি যোদ্ধাদের জয়লাভে জন্ম নিল নতুন এক দেশ বাংলাদেশ যাঁর ভাষা বাংলা।
তাই ১৯৫২র রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারি তা দেশ বিদেশের আপামর বাংলাভাষীর কাছে এক অবিস্মরণীয় দিন, তাকি কখনও ভোলা যায় ?
(সূত্রঃ “বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি”- বদরুদ্দীন উমর, নভেম্বর১৯৭০। ” সংস্কৃতির পথ”- কামরুল হাসান, ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী মেলার স্মারক পুস্তিকা – ১৯৭২ এপ্রিল।)
অনেককিছু জানলাম। ভালো লাগল।