প্রবন্ধঃ একুশে ফেব্রুয়ারী ও ফেব্রুয়ারীর বাংলাদেশ – সত্যকাম বাগচী

একুশে ফেব্রুয়ারী ও ফেব্রুয়ারীর বাংলাদেশ।
সত্যকাম বাগচী

অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছে ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি ও ২১ শে বইমেলাকে নিয়ে কোনও এক ফেব্রুয়ারি’তে।, নানান কারণে হয়ে উঠেছিলো না। অবশেষে গতকাল কলকাতা স্টেশন থেকে যে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী এক্সপ্রেস ছাড়লো, সেটা আমাকে নিয়েই ছাড়লো।
দারুন এক উত্তেজনা মনের ভেতর— অল্পসময়ের মধ্যেই সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে–
পদ্মা ও যমুনা পার হলাম যথাক্রমে হার্ডিঞ্জ ও বঙ্গবন্ধু ব্রীজ পার হয়ে।
পার হয়ে আসলাম কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলা। প্রসঙ্গত জানাই পাবনা আমার পিতৃ পিতামহের দেশ।
ফেরার পথে পাবনায় কিছুক্ষণ থেকে দেখে নেবো পাবনা বইমেলা।
অবশেষে হাজীপুর হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট’এ এসে পৌঁছলাম।
একরাতের জন্য ঢাকা। চট্টগ্রাম ঘুরে ২১ শে ফেব্রুয়ারী আবার আসবো। ঢাকায় তাই বসে না থেকে আজই একুশে বইমেলায় যাওয়ার ইচ্ছে। এইরকম একটা সময়ে পরিত্রাতা হিসেবে হোটেলে এসে উপস্থিত হলো আমার ভগ্নীসমা বন্ধু সামিয়া কালাম। সামিয়া ঢাকার একজন জনপ্রিয় রেডিও জকি।
, বললো “দাদা চলেন, একটু ‘ফ্রেশ হয়ে আসেন , চা নাস্তা করে বইমেলায় যাই”।
কিছুক্ষণ আগেই মসিউর রহমান মিল্লু’ও ফোন করেছিলো যে সেও অপেক্ষা করছে। একে শুক্রবার–ছুটির দিন– বইমেলার ভীড়ে সব রাস্তাই প্রায় বন্ধ, সামিয়া একটা ‘সি এন জি’ (কলকাতারই অটো’র মতন নিরাপত্তার কারণে চারিদিকে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা।)– বুক করেছিলো ফোন করে।

ঢাকা বইমেলায় সামিয়া ও মসিউর রহমান মিল্লু।
৩ ঢাকা বইমেলায় আমি, সামিয়া কালাম ও মিল্লু।.

পৌঁছলাম বইমেলায়। ‘ঢাকার একুশে বইমেলা’– অনেকদিনের স্বপ্ন। সামিয়া ও মিল্লুর সৌজন্যে ঢুকলাম। অনেক ঘুরলাম– শুধু বই আর বই !! কলকাতা বইমেলার মতন খাওয়ার দোকানের বাহুল্য নেই বললেই চলে। ২৩৫ থেকে ৫৪৭ নং স্টল খুঁজে পেতে কোনও কষ্ট হয় না।
সামিয়া’র একটা বইপ্রকাশ হয়েছে, আমাকে একটি দিলো।
প্রাণভরে মেলা দেখলাম।


মেলা থেকে বেড়িয়ে শাহবাগ চত্বরে গেলাম। দেখলাম প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি।
১৮ ই ফেব্রুয়ারি, দু রাত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে “হোটেল নাদিশা ইন্টারন্যাশনাল”এ অতিবাহিত করে আজ যাচ্ছি “কক্সবাজারে”। তার আগে একটু অভ্যাসমতন বাংলাদেশের সকালিক খবরের কাগজ “প্রথম আলো” পড়েছি।
চলে আসি একেবারে একুশে ফেব্রুয়ারীতে, বিস্তারিত বাংলাদেশ নিয়ে লেখা আগামীতে অন্য কোনও সংখ্যায়।

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। মহাণ একুশে।
আমি গর্বিত যে আমি একজন বাঙালি।
— অপূর্ব এক অনুভূতি এবার। একুশে ফেব্রুয়ারী আমি বাংলাদেশে। এখন আছি চট্টগ্রামে কিছুক্ষণ পরেই যাত্রা শুরু করবো ঢাকার দিকে। আমি গর্বিত যে আমার মাতৃভাষা বাঙলা। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই সেই সব শহীদ’দের,—-যাঁদের রক্ত ও প্রানের বিনিময়ে এই প্রাপ্তি।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক দিন। রক্তরাঙা ফাগুনের আগুনমুখো একুশে ফেব্রুয়ারি আজ । বাঙালির শোক আর সংগ্রামের দিন। বাঙালির এ এক চিত্তজাগরণের গল্প। এ দিনটিই বাঙালিকে নতুন করে বেঁধেছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বন্ধনে। ভয়কে তুচ্ছ করে মায়ের ভাষা বাংলার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন যেসব সাহসী সন্তান- তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর এ দিন।
একুশে সকালে ছিলাম চট্টগ্রামে। মিছিলের পর মিছিল, একুশের প্রভাতফেরী–গলায় সেই গান, আর হাতে একুশে স্মরণের নানান মাধ্যম।
নিশ্চয়ই রাস্তাঘাট সব বন্ধ !!!! না বন্ধু না, কোনও রাস্তা বন্ধ না!!
কেমন ছিলো সেই সব মিছিলের চরিত্র ?

একুশে চট্টগ্রামে একলাইনে ভাতফেরী।


রাস্তার একেবারে বাঁ দিক দিয়ে সারিবদ্ধ সবাই হেঁটে চলেছে। আর পুরো রাস্তা দিয়ে আমাদের মতন সাধারণ জনতা, হেঁটে বা গাড়িতে।(ছবি দিয়েছি)
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নেতারা একজনও পড়ছেন এই প্রতিবেদন !!!!!!!!!!
চট্টগ্রাম সফরের শেষ দিনে একুশে ফেব্রুয়ারীর ভোরে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সেই রাস্তার একদিক দিয়ে যাওয়া প্রভাতফেরী এবং তারপর নতমস্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এলাম বীরকন্যা প্রীতিলতা’কে। দেখে এলাম তাঁর স্মৃতিসৌধ ও সেই ইউরোপীয়ান ক্লাবকে। যে ক্লাবের বাইরে লেখা থাকতো—
“কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ”।

চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাব।
ক্যাপশান কি দরকার.
প্রীতিলতা মূর্তির কাছে আমার ভগ্নীপতি ও মুস্তাফা কামাল আহমেদের সাথে আমি।


বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারই প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ, যিনি সর্বপ্রথম ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহন করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য । অগ্নিযুগের এই অগ্নিকন্যা ১৯১১ সালে ৫ই মে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দাদার, মাতার নাম প্রতিভা ওয়াদ্দাদার । তিনি ১৯৩২ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমন শেষে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সাথে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড বিষ খেয়ে দেশমাতৃকার জন্য মাত্র ২১ বৎসর বয়সে নিজের জীবন আত্মহুতি দেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ।
তবে এই দর্শন ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে আমার প্রিয় বন্ধু ও সুহৃদ মুস্তাফা কামাল আখতারের সৌজন্য ও সহযোগিতায়। ভোর পাঁচটায় নিজের অসুস্থ্ স্ত্রীকে ঘরে রেখে এসে, তিনি ছুটে এসেছিলেন আমার হোটেলে অত সকালে, যেহেতু আমরা সকাল নটায় বেড়িয়ে যাবো ঢাকার উদ্দেশ্যে। তিনি তার নিজের গাড়ি করে প্রথমে দেখিয়ে এনেছিলেন আমাকে ও আমার ভগ্নীপতিকে এই পূণ্য স্মৃতিসৌধ। পরে ঢাকা যাওয়ার সময়ে আমার নিশন গাড়িকে পথ দেখিয়ে আমরাই নিয়ে গিয়েছিলাম এই পূণ্য স্মৃতিসৌধ দেখাতে।এই স্মৃতিসৌধের কথা চট্টগ্রামের অনেকেরই জানা নেই প্রচারের অভাবে, তাই আগের বিকেলে খুঁজে না পেয়ে হোটেলে ফিরে এসে জানিয়েছিলাম তাকে।
তাকে আমাদের সবার পক্ষ্য থেকে অনেক সালাম ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

একুশে ঢাকায় রিক্সা
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমি ও ভগ্নীপতি দূষ্মন্ত নাগ।

আজ চট্টগ্রাম থেকে সারা রাস্তা শহীদ স্মরণ দেখতে দেখতে ঢাকায় এসেছি সন্ধ্যাবেলায়। এবার গন্তব্য শহীদ মিনার যা আমার অনেকদিনের সাধ। সামিয়ার পরামর্শ মতন হোটেলের সামনে দাঁড়ানো ঢাকার বিখ্যাত সাইকেল রিক্সায় উঠে বসলাম একটা রিক্সায় দু’জন করে এবং ঐ রিক্সাতেই আবার হোটেলে ফিরবো এই কথা বলে নিয়ে। অনেকটা দূরত্ব ,একুশে ফেব্রুয়ারীর সন্ধ্যায় তাও আবার যাওয়া আসা। কতো দিতে হলো রিক্সা চালককে? থাক পরে বলবো।
ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত শহরের কেন্দ্রস্থলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বহিপ্রাঙ্গনে।
একুশের বিকেল থেকেই সাইকেল রিক্সা ছাড়া আর সব যানবাহন বন্ধ ঐ শহীদ মিনারমুখী সব রাস্তায়। তার প্রায় এক কিলোমিটার দূরেই রিক্সা দাঁড়িয়ে গেল, রিক্সাচালকরা বললেন আর জোড় করে ভেতরে গেলে নাকি ফেরার সময় আমরা আর রিক্সা খুঁজে পাবোনা।
রিক্সা থেকে নেমে পড়ে আমরা একসাথে হেঁটে চললাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে।
অমর একুশে’তে শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম নতমস্তকে,ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে-।
চোখ বারবার ভিজে উঠলো জলে। কিছুক্ষণ থেকে আবার আমাদের রিক্সা খুঁজে বের করে ফিরে এলাম হোটেলে।রিক্সাচালকরা কতো নিলেন ! জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলাম অন্যদিন যাতায়াত দুইশত নিই আজ তিনশত দ্যান। পারলাম না ওদের দাবীমতন দিতে পকেট থেকে একটি বাংলাদেশী পাচশত টাকার নোট বেড়িয়ে এলো যেন নিজে নিজেই। দিলাম তার হাতে, দু’হাত দিয়ে অতি ঊষ্ণতার সাথে আমার হাতটা চেপে ধরলো বললেন ‘আবার আইসেন, এখানে কোনও সমস্যা নাই’

লালন একাডেমির আবদুস কুদ্দুস মির্ধার সাথে।
পাবনা একুশে বইমেলায় রফিদের সাথে।
লালনের মাজার।


পরের দিন সকালে ও সারাদিনে ঢাকা দর্শন এবপর রাতে হোটেলে বিশ্রাম।তার পরের দিনের গন্তব্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহ—রবীন্দ্রনাথে বাড়ি—লালন স্মৃতিসৌধ। এবং পাবনার বইমেলা হয়ে ফেরার রাস্তায়। সেসব বিস্তারিত অন্য কোথাও অন্য কোনও খানে।
সত্যিই বাংলাদেশের সবত্র অনুভব করলাম ‘’কোনও সমস্যা নাই’’।

লেখকঃ সত্যকাম বাগচী।
একজন নাট্যকর্মী, আবৃত্তি শিল্পী ও ভ্রমণপিপাসু গবেষক।

3 thoughts on “প্রবন্ধঃ একুশে ফেব্রুয়ারী ও ফেব্রুয়ারীর বাংলাদেশ – সত্যকাম বাগচী

  1. অসাধারণ! সুন্দর বর্ননা। এই যাত্রার সমস্ত অভিজ্ঞতা জানার ইচ্ছে রইল।

Leave a Reply to Krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *