নিবন্ধঃ ভাষার রাজনীতি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

ভাষার রাজনীতি
অনিরুদ্ধ সুব্রত

সভ্যতার আদি কাল থেকে ‘ভাষা’ একটি রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত বিষয় । অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ‘ধ্বনিগত মাধ্যম’টি কালক্রমে তার গোষ্ঠীতে জনপ্রিয় ও পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হলেই হলো না । একদিন তাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে দখলদার শক্তির কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হয় । ফলে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিনে আলোচ্য ভাষাটি একক কি না , সেটা যেমন বিবেচ্য, তেমনি গোষ্ঠী মধ্যে একাধিক ভাষা প্রচলিত কি না সেটিও অন্যতম বিচার্য । সে ক্ষেত্রে যদি ঐ ধ্বনিগত মাধ্যমটি এক এবং অদ্বিতীয় হয়, তবে জনগোষ্ঠীর ক্ষমতাবাণ অংশ তার স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা দ্বন্দ্ব করে না। বরং ভাষাটির নানাবিধ বিকাশে শক্তিমান অংশ তৎপর হন । কিন্তু যদি একই জনগোষ্ঠীর বিস্তৃতির মধ্যে একাধিক ভাষা ব্যবহার হতে থাকে, তবে সেই দীর্ঘ অভ্যাস থেকে মাত্র একটি ভাষাকে সর্বজনগ্রাহ্য বলে স্বীকৃত করে তোলাটা তখন হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার ‘ভাষা-রাজনীতি’র দাপট।

“নর্মানদের মাতৃভাষা ফরাসী ; ব্রিটেনে নর্মানজয়ের পর দুই শতাব্দী ধরিয়া ফরাসী ভাষা ইংরেজিকে সম্পূর্ণ কোণঠাসা করিয়া রাখিয়াছিল । রাজ-সভায়, সভ্য সমাজে আলাপ- আলোচনা ও ভাব – বিনিময়ে, বিচারালয়ে, আইন-সভায় সর্বত্রই ছিল ফরাসী ভাষার একাধিপত্য । ইংরেজি-ভাষা পরাধীন জাতির ভাষা, ইতর জনসাধারণের ভাষা বলিয়া সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল হইতে নির্বাসিত হইয়া দেশের অখ্যাত কোণগুলিতে আত্মগোপন করিয়াছিল ।” ( শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, ১৯৪৫)

তাহলে একটা কথা স্পষ্ট যে, পরবর্তী কালে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ শক্তিও একদা ভাষাগত আগ্রাসনের শিকার হয়ছিল । এবং প্রায় দুই শত বছর সেই আগ্রাসন চলেছে । রাজনৈতিক ক্ষমতাই ঠিক করে দিয়েছে, কী হবে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাব বিনিময়ের মাধ্যম । এক কথায় একে ‘ভাষার রাজনীতি’ বললে অত্যুক্তি হয় না ।

প্রাচীন ভারতবর্ষে আর্য ভাষার প্রভাব ও প্রতিপত্তি এবং পরবর্তী দুই আড়াই হাজার বছরের প্রভাবিত ধারা ঐ একই ভাষার রাজনীতি দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়েছে । ফলে প্রথম থেকেই স্থানীয় ভাষা বা প্রাকৃত ভাষা পদে পদে অত্যাচারিত ও দূরবর্তী এবং ব্রাত্য হয়ে কোনও মতে স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে । যদিও পরবর্তী ইতিহাসের ধারায় আর্য ও প্রাকৃতের সংমিশ্রণে আজকের বহুভাষার ভারতবর্ষ ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বঙ্গদর্শন’ এ ১২৮৫ বঙ্গাব্দে, ‘বাংলা ভাষা’ প্রবন্ধে বাংলা লিখিত ভাষার একাধিপত্য সম্বন্ধে লিখেছেন, ” বাংলার লিখিত এবং কথিত ভাষায় যতটা প্রভেদ দেখা যায়, অন্যত্র ততটা নহে । লিখিতটির নাম ‘সাধুভাষা’ ; কথিতটির নাম ‘অপর ভাষা ‘ । পুস্তকে প্রথম ভাষাটি ভিন্ন, দ্বিতীয়টির কোনও চিহ্ন পাওয়া যাইত না। সাধুভাষায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ সকল বাঙ্গালা ক্রিয়াপদের আদিম রূপের সঙ্গে সংযুক্ত হইত । যে শব্দ আভাঙ্গা সংস্কৃত নহে , সাধুভাষায় প্রবেশ করিবার তাহার কোনো অধিকার ছিল না । লোকে বুঝুক বা না বুঝুক, আভাঙ্গা সংস্কৃত চাহি । অপর ভাষা সেদিকে না গিয়া, যাহা সকলের বোধগম্য, তাহাই ব্যবহার করে ।”

আমরা সকলেই অবগত যে এর পরবর্তী পরিবর্তন কেমন হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, স্বামী বিবেকানন্দ প্রত্যেকেই তাঁর তাঁর মতো চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষা বিশেষত সাহিত্যের ভাষাকে সাধুভাষার আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে । তবে যেটা লক্ষ্যণীয়, ‘অপর ভাষা’ বলে লৌকিক মানুষের মুখের ভাষাকে যেভাবে ব্রাত্য করতে চাওয়া হয়েছিল, তাও এক জাতীয় ভাষা-আগ্রাসন বা ভাষার রাজনীতি । কালক্রমে সেই দখলদারি মানসিকতা ধোপে টেকে নি।

সাম্প্রতিক কালে সমস্ত ভারতে এক এবং অদ্বিতীয় হিসেবে হিন্দি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি ও ‘রাষ্ট্র ভাষা’ তকমা দানের যে ঠান্ডা প্রচেষ্টা চলছে, এক বাক্যে তাকেও এক জাতীয় ভাষার রাজনীতি বা জোর পূর্বক দখলের উদ্যোগ বলে ধরে নেওয়া যায় । এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আবু সয়ীদ আইয়ুবের লেখা থেকে উল্লেখ করা যায়,
” যে ভাষাগুলি আমাদের দেশের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা, তার প্রত্যেকটি ভাষাই আমাদের জাতীয় ভাষা । এদের মধ্যে কোনও একটিকে ‘রাষ্ট্রভাষা ‘ নামে অভিহিত করে সকলের ঊর্ধ্বে কোনও রাজাসনে বসানো যায় না ; এক শ্রেণীর নাগরিককে শুধু বিশেষ এক অঞ্চলে তাঁদের জন্ম বলে অতিরিক্ত কোনও ক্ষমতা বা সুবিধা দেওয়া যায় না ।………. সর্বস্তরে শিক্ষার বাহন মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা হতেই পারে না—- । “( ‘হিন্দি ইংরেজি ও মাতৃভাষা ‘ , দেশ পত্রিকা, ১৯৫৭)

সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে উপভাষাগত প্রভাব বা আঞ্চলিক প্রচেষ্টা প্রায় শূন্য । সে যেন তথাকথিত শহর কলকাতার শিষ্ট ভাষা ছাঁদের প্রতিরূপ হিসেবে পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত একই। এও কি এক প্রকার ভাষার রাজনীতি ? পাশাপাশি বাংলাদেশের সাহিত্য শিল্পে এখনও যথারীতি একই বাংলার বিচিত্র উপভাষাগত রূপের আলাদা আলাদা সৃজন চলছে । যদিও সেখানেও অল্প হলেও একটা শহর সভ্যতা কেন্দ্রিক শিষ্টতার প্রভাব প্রতিপত্তি অস্বীকার করতে পারা যাবে না।

মোটকথা সাধারণের মুখের ভাষাই যে প্রকৃত মাতৃভাষা, পদে পদে হয় সংখ্যাধিকের চাপে নতুবা ক্ষমতাবান অংশের জোরে অবমানিত হতে হয়, হচ্ছে । যতক্ষণ না এই ভাষার রাজনীতি সহানুভব দিয়ে দূর করা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মাতৃভাষা প্রীতি কাজে আসছে না । রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে যে শক্তি থাকে, তাকেও ভাষা সন্ত্রাস নিয়ে যথেষ্ট ভাবতে হবে । কারও উপর কোথাও কোনও ভাবে ভাষা আরোপিত হচ্ছে কিনা, কোনও অল্প সংখ্যক মানুষের মাতৃভাষা কোথাও ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে কিনা দুটিই আজকের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে বিবেচনায় রাখতে হবে ।

ভাষা আকাশ থেকে পড়ে নি, একই জনগোষ্ঠীর একই জনজীবন ধারা ও অভিজ্ঞতা একটি ভাষার জন্ম দিয়েছে । সে তাদের মাতৃতুল্য, কারণ সেই মাধ্যমেই ঐ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা আত্ম প্রকাশে সাবলীল ও নির্ভয়, অকপট । তার শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব কিছুই প্রকাশ ও গ্রহণ করার সহজ পথই সেই ব্যবহৃত ভাষা, যেখানে সেই মানুষ গুলোর সুখ ও দুঃখ বলার একমাত্র সহায়।

2 thoughts on “নিবন্ধঃ ভাষার রাজনীতি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. খুব ভাল লেখা। আর একটু বিস্তারিত হলে ভাল হতো আরও।

Leave a Reply to Krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *