ছোটগল্পঃ মন্দিরা গাঙ্গুলী

আমার আমার
মন্দিরা গাঙ্গুলী

আজ সকালটাই অন্যরকম। যদিও ভাতের হাঁড়ি চাপানো আছে ওভেনে, উজান একটু পরেই
ওয়াশরুমে যাবে, জানে তিস্তা। ওর চানটান করে বেরোতে ঠিক বাইশ মিনিট, তার মধ্যেই
খাবার রেডি করে ফেলবে। এখন হাতে চায়ের কাপ সঙ্গে ইয়ার ফোনে শুনতে থাকা মিষ্টি
মিষ্টি গান আর উজানের হাতে খবরের কাগজ। তিস্তার কানে এখন “ সেই সুরে কাছে
দূরে জলে স্থলে বাজায়,,,” কাগজটা রেখে উজান একবার তাকিয়ে বলে –- “ গান শুনছো
সকালবেলা! কাজ নেই?” বলেই স্নানের জন্য উঠে পড়ে। তিস্তা উত্তর না দিয়ে হেসে
রান্নাঘরের দিকে যায়। ভাত নামায়, ফ্রিজ থেকে বের করে রাখা খাবার গুলো
মাইক্রোওয়েভে একে একে গরম করে। রাতেই বেশির ভাগ রান্না সেরে রাখে ও। এখন
তিনজনের টিফিনের নুডলস বানাচ্ছে আর একটা ওভেনে বেগুন ভাজা। ভাজা, নুডলস
এসব উজানের পছন্দ হলেও কমই দেয় ওকে। আজ একটু খুশি করতে ইচ্ছে হল,
ভ্যালেন্টাইন ডে বলে কথা!
থালায় ভাত সাজিয়ে, পাশে বাটিতে বাটিতে সাজিয়ে দেয় সব্জিডাল, বেগুন ভাজা,
মোচার ঘন্ট, গুর্জালি মাছের ঝোল, চাটনি। উজান খেতে বসলে এবার টিফিনটা মন
দিয়ে বানাতে থাকে। বিভিন্ন সব্জিতে রঙিন করে তোলে । এই রং মন ভালো রাখবে
এই ভেবে । গান এখন ইয়ারফোন ছাড়াই চলছে, সবাই শুনতে পাচ্ছে, “ প্রথমত আমি
তোমাকে চাই”– গুনগুন করতে করতে টিফিনবক্স গোছাতে থাকে, আরেকটি বক্সে
দুতিন রকম ফল কেটে ব্যাগে ভরে দিয়ে উজান কে বলে “ আজ আমরা একটু
গড়িয়াহাট যাব, অফিসের পর”
— “আমরা মানে?”
— “আজ ভ্যালেন্টাইন ডে না! তাই ওরা বলছে আমাকে, ওদের সাথে একটু ঘুরতে
যেতে, ইপ্সিতা আর জুঁই।“
— “সে ঠিক আছে, ঘুরে এসো। কিন্তু এসব ভ্যালেন্টাইন ডে ফে আমি বুঝিনা, যত
সব ন্যাকামি! ছেলেপুলেদের মাথা খাওয়া!”
— “আরে! শত্রুতা, মারামারির দিন তো নয়! প্রেমেরই তো দিন! জামাইষষ্ঠী,
ভাইফোঁটা এসব যদি মানো তবে কোন বিশেষ দিন যদি বিশেষ জনের জন্য হয়,
ক্ষতি তো নেই! আমার তো দারুণ লাগছে। সকাল থেকে কত প্রেমের গান
শুনছি।“

ছবি-সুপ্রিয় ঘোষ

উজান ভ্রু কুচকে বলে, — “শোন, তোমার ওই প্রেম প্রেম আহ্লাদটা নিজের
মধ্যেই রেখ। ছেলে বড় হচ্ছে, ও যেন না বোঝে।“
উজান বেরিয়ে গেল, একবারও উইশও করলনা বা অন্যকিছু। বেরসিক। ইমন
ফিরেছে টিউশন থেকে। বাড়িতে ঢুকেই বলে — “বাবা তোমায় কিছু দিল?”
— “চিনিস না তোর বাবাকে!”

— “আরে ঠিক দেবে, গতবার চকলেট এনেছিল মনে নেই!”
— “সে তুই বলেছিলি, তাই।“
ইমন স্নান করে স্কুলের জন্য রেডি হলে খাইয়ে দেয় তিস্তা।
ক্লাস টেনে পড়া ছেলেকে এখনো খাইয়ে না দিলে ঠিকমত খায়না । মায়ের গালে
দুটো হামি খেয়ে স্কুলে চলে যায়।
হাতে খুব কম সময়, চটপট ঘরের কাজ শেষ করে স্নানে চলে যায়। চুলে
শ্যাম্পু দিয়ে স্নান সারতে দশ মিনিট। মাথায় একটা গায়ে একটা তোয়ালে
জড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে তিস্তা। গায়ের তোয়ালে ফেলে হলুদ একটা
সালোয়ার কামিজ পরে নেয়। লাল পরতে লজ্জা লজ্জা করছে, অফিসের সবাই
যদি মজা করে! ড্রায়ারে চুল কিছুটা শুকিয়ে নিয়ে পিছনে খামচি ক্লিপ আটকে
নিল। মুখে হাতে সানস্ক্রিন চোখে স্মোকি ব্ল্যাক কাজল, ঠোঁটে হালকা
লিপস্টিক, কানে মানানসই পাথরের দুল। এতটুকুই সাজ, তাতেই বেশ দেখাচ্ছে।
ফর্সা লম্বা তন্বী তিস্তা। দেখে বোঝাই যায়না বয়স চল্লিশ পেরিয়েছ। এখনো
অনেক মুগ্ধ চোখ দেখতে পায় ও। একটু অস্বস্তি লাগলেও, মন্দও যে লাগে
না অস্বীকার করতে পারেনা তিস্তা।
অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে ওরা। লাল কুর্তি, চন্দন
রঙের লেগিংসে জুঁই কে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মেয়েটার স্বভাবটাও মিষ্টি।
অনেক গুণও আছে। ভালো গায়, ছবি আঁকে। তাই তিস্তা একটু বেশিই পছন্দ
করে ওকে। আর ইপ্সিতা তো এমনিতেই অসাধারণ সুন্দরী। ও আজ লাল
সিল্কের শাড়ি পরেছে। ওর দুবছরের মেয়ে আছে। তিস্তার থেকে ছবছরের ছোট
হলেও খুব কাছের বন্ধু ইপ্সিতা।
সত্যি, গড়িয়াহাট যেন অন্য রকম সেজে উঠেছে আজ। কত ধরনের ফুল,
গোলাপ ই কত রকম! সেসব অন্যসময় তেমন চোখে পড়েনা। কতদিন পর কাজ
ছাড়া ঘুরতে এসেছে। ছেলের পড়াশোনা, ঘরের কাজ আর অফিসের বাইরে নিজের
ভালোলাগা গুলো নিয়ে আর ভাবেওনা তেমন। আজ বেশ আনন্দ হচ্ছে ওর।
ইপ্সিতা ডায়েট করে, তাই ওরা কম ক্যালোরির খাবার খুঁজে ধোকলা আর
ফলের রস খেল। তারপর ঘুরতে লাগল, চারদিকের দোকান দেখতে দেখতে।

তিস্তা নিজের জন্য কিনল দুটো হার দুলের সেট, একটা ব্যাগ, ছেলের জন্য
সুন্দর একটা পেন। জুঁই কিনল একটা ফটোফ্রেম, মায়ের জন্য ব্যাগ। ইপ্সিতা
বরের জন্য সুন্দর একটা শোপিস কিনল, কালো ছেলে লাল মেয়ে
আলিঙ্গনবদ্ধ, মেয়ের জন্য বেশ কিছু ক্লিপ আর হেয়ারব্যান্ড। জুঁই বলল, —
তিস্তাদি, উজানদার জন্য নিলেনা কিছু!
— নাহ্, ও হয়ত বিরক্ত হবে।
— নিয়ে গেলে বিরক্ত কেন হবে, কিছু নাও, খুশিই হবে।
তিস্তা নিজের প্রিয় কিছু অর্কিডের ফুল কিনল, শোবার ঘরের ফুলদানিটায়

রাখতে পারবে ভেবে।
বলল, “ দেখো এইযে ফটোফ্রেম টা নিয়ে যাব, মা দেখে ভাববে কেউ
নিশ্চয়ই দিয়েছে,” বলে খুব হাসল। তিস্তা মনে মনে বলল, — কেন নয় কেন?
কেউতো দিতেই পারত তোকে আজ, একজন সুন্দর মানুষ কি নেই, এমন মিষ্টি
মেয়েটাকে আজ উপহার দিতে পারে! সে জন অবশ্যই আসবে তোর জীবনে,
একটি একলা গোলাপের সাথে প্রেমের ইশারায়। দেখবি, খুব ভালোবাসবে তোকে।
— ও তিস্তাদি, কী ভাবছ? বলে খিলখিল করে হেসে ওঠে জুঁই। ছোটখাটো
কেনাকাটা করে, হাসি মজায় ভালোবাসার বিকেলটা কেটে গেল ওদের। আজ
হাওয়াটাও অন্যরকম, শীত নেই। চারদিকে প্রেম প্রেম গন্ধ।
হঠাৎ ইপ্সিতা বলে ওঠে, – তিস্তা, তোমার সেই আবিরের খবর কি?
— আবিরের আচরণ টা ঠিক লাগছেনা আজকাল।
— কেন?
— আমাকে ইনবক্সে যে সব কবিতা পাঠায়, এত সুন্দর, তবে সেদিন বিভাসদার কবিতার বইয়ে একটা কবিতা পেলাম হুবহু আবিরের একটি কবিতা, কয়েকটা লাইন শুধু আগে পরে। বিভাসদার লেখা পাঁচ বছর আগের, আর আবির সাতদিন আগে পাঠিয়ে বলেছে তখনই লেখা। সন্দেহ হচ্ছে। প্রোফাইলে একটি মাত্রই ছবি বারবার পরিবর্তন করে। আর ছবিটা থিয়েটার অভিনেতা সৈকত সেনের মতো যেন, পাশ থেকে তোলা। আগে এত ভালো করে দেখিনি। খুব সন্দেহ হচ্ছে জানো তো। ও ফেক, অন্যের কবিতা নিজের নামে বলে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছে। আমি আগে বুঝিনি।
— ওহো, তেমনটাই হলে ব্লক করে দাও

মাস ছয়েক ধরে ফেসবুকে বন্ধু আবির। হাসি মাখা সুন্দর মুখ। কবিতা লেখে,
কলেজে পড়ায়। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব জমে
ওঠে ওদের। তিস্তার খুব ভালো লাগে ওর সাথে কথা বলতে। কত বিষয় জানে,
তিস্তার মতই বই পড়ার নেশা। কথা বলার মত টপিক অনেক আছে। এমন বন্ধু
পাওয়া সৌভাগ্যের। আর উজান! গল্প করেনা, কখনো ওর প্রশংসা করেনা,
ওর ইচ্ছে অনিচ্ছার মূল্য দেয়না, কত বছর একটা সিনেমাও দেখেনি ওরা।
তিস্তার মন খারাপ থাকত সবসময়, উজানকে বলেছে সেই মন খারাপের কথা,
উজান গুরুত্ব দেয়নি। সে নিজের অফিস, অফিসের পর সময় পেলে পাড়ার
ক্লাবে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে চলেছে। তিস্তার সাথে সময় কাটানো বা
গল্প

করার প্রয়োজন মনে করেনি কোনদিন। আবিরের সাথে বন্ধুত্ব হবার পর
অনেক ভালো ছিল তাই। কিন্তু কদিন ধরে আবির যেন বেশি ব্যক্তিগত কথা
বলছে। এটা আবার তিস্তার ভালো লাগছেনা।

কলেজে পড়ায় বলেছিল, কিন্তু কাল যখন জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় এখন, বলল অফিসে, সেখানে কী করছে জানতে চাইলে বলল, ও নাকি ওই অফিসের অফিসার। এবং ইংরাজী অক্ষরে লেখা অফিসার শব্দটার বানান ভুল।
তারপর লিখেছিল“ তোমাকে সব সময় পেতে ইচ্ছে হয়।“
— “আমি তো রোজই তোমার সাথে কথা বলি।“
— “এভাবে নয়, সামনে এসো। এখনই, মনে মনেই এসো আমার কাছে। বুকের কাছে
এসো, তোমার সুন্দর ঠোঁটে গভীর চুমু খাই!”
তখনই কোন উত্তর না দিয়ে লগ আউট করে দেয় তিস্তা। বাজে লাগে ওর।
আজ সকালে প্রোফাইল ছবিতে কুুুুুরুচিপূর্ণ কমেন্ট। আর কথা বলবেনা ও।
বিবাহিত জেনেও এমন কিভাবে বলে! বন্ধু ভাবাটাই ওর ভুল হয়েছে। এভাবে
কাউকে আর বন্ধু মনে করবেনা। একবার ফেসবুক খুলল মোবাইলে। আবির
মেসেজ করে রেখেছে, ঘন্টাখানেক আগে।
— “বরের আদর খাও বুঝি রোজ? তাই আমাকে পাত্তা দিলেনা? আমি এমন আদর
করতে পারি, যা তুমি কখনো পাওনি। কখন আসবে সোনা আমার কাছে। কবে
পাব তোমায়?”
তিস্তার গা গুলিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ডলিস্ট খুলে ব্লক করে আবির
কে। ফেক নোংরা কুৎসিত ও। অনেক ভালো ওর গোমড়া
মুখো বর। ওই একজনের বুকেই নিশ্চিন্ত আশ্রয় ওর। কাউকে চায়না আর।
অনেক ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। বড় করে নিঃশ্বাস নেয় । নতুন করে যেন
প্রেমে পড়ে। বেরসিক, পুরোনোপন্থী, প্রেম না জানা মানুষটা জানতেও
পারলোনা কি অমূল্য উপহার সে পেল।
জুঁইয়ের কথায় হুশ হয় তিস্তার। — “ভালোই মজা করলাম প্রেম দিবসে, তাইনা?”
— “হ্যাঁরে, দারুণ পালন করলাম।“
ওরা দুজন একই দিকে থাকে। তিস্তাকে একটা বাসে তুলে দিল ওরা। জানলার
পাশে জায়গাও পেয়ে গেল। কি যে ভালো লাগছে সন্ধেবেলা আলো আলো শহর
আর এই হাওয়া। সব প্রেমিক মন প্রেমে থাকুক আজ। ভাইয়ের বৌ টিয়া ওকে
ফোনে উইশ করেছিল, ওরাও ভালোবাসায় থাকুক।
বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরই ছেলেও স্কুলের পর টিউশন পড়ে ফেরে।
— “তোমাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে মা।“
— “তেমন কিছু সাজিনি মোটেই।“
— “সত্যি, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। আমার সুন্দর মিষ্টি মা। বলে,
মাকে গলা জড়িয়ে আদর করে।“

তিস্তা হাসে। বোঝে, আসলে মনে খুশি আছে বলেই ভালো লাগছে ওকে।
চট করে ফ্রেশ হয়ে ইমনকে খেতে দেয় তিস্তা। উজান এসে গেছে, মুখে যেন
একশোটা বিরক্তি, এমনই মনে হয় মুখ দেখে। দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে
আসছিল তিস্তা। উজান ডেকে ওঠে –- “শোনো, এটা নিয়ে যাও!” ব্যাগ থেকে
একটা প্যাকেট দেয় ও। চকলেট!
— “আমার জন্য? বলে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে ও।“
— “তোমার হাতে যখন দিলাম, তখন তোমার ছাড়া কার?”
— “কি মজা, থ্যাঙ্কু উজান।“
ওর ছেলে মানুষি দেখে উজানও হেসে ফেলে। তিস্তা দৌড়ে এসে ইমনকে দেখায়।
ইমন বলে, — “দেখেছ, বললাম না, বাবা ঠিক কিছু আনবেই!”
তিস্তা চকলেট টা খুলে কিছুটা ভেঙে ইমনকে দেয়। তারপর আরেকটু ভেঙে
উজানের দিকে এগিয়ে দেয়। উজান তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ভ্রু কুচকে বলে
–- “আমি খাবনা, তোমরা খাও। আমার এসব ভালো লাগেনা। তোমরা ভালোবাসো
তাই আনি।“
তিস্তা ছাড়েনা, বলে, — “জানি তোমার ভালো লাগেনা। তবু খেতে হবে আজ।“ উজান
বাধ্য হয়ে মুখে দেয়।
এবার এক টুকরো নিজেও মুখে দেয় তিস্তা। খুউব ভালো খেতে।
উজান বলে, — “এই চকলেট টা জানো কত দাম! আড়াইশো টাকা। একটা চকলেটের
এতো দাম, ভাবা যায়!”
— “কী?” থেমে যায় তিস্তা। মুখের চকলেট মুখেই থাকে। উজান এতো বেরসিক যে
কেন? কেউ কি এমন কথা এই সময় বলে! লোকটা একদমই রোমান্টিক নয়।
বেরসিক, গোমড়া মুখো। কিন্তু পরক্ষণেই খিলখিল করে হেসে ওঠে তিস্তা মনে
মনে বলে ওঠে, “ আমার আমার আমার।“

ছবি-সুপ্রিয় ঘোষ

11 thoughts on “ছোটগল্পঃ মন্দিরা গাঙ্গুলী

  1. খুব ভালো লিখেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মুখোশে ঢাকা মুখটি কাহিনির মোড় ঘুরিয়ে দিল।
    ভালো লাগলো।

  2. খুব মিষ্টি প্রেমের গল্প। ভাল লাগল খুব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *