অণুগল্পঃ নিঃস্বতা – স্বপন নাগ

নিঃস্বতা
স্বপন নাগ

‘কোনো মানে হয় !’
সুজয়ের এই বিস্ময়টুকু কিছুতেই মানতে পারেনি শর্মিষ্ঠা। অথচ সুজয় তো যথেষ্ট বুদ্ধিমান, শর্মিষ্ঠার প্রতি কেয়ারিংও। কলেজের দিনগুলো থেকেই তো ওদের আলাপ। তারপর ঘনিষ্ঠতা। এবং বিয়ে। সুজয়ের সেই রিঅ্যাকশন শর্মিষ্ঠাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল, একা করে দিয়েছিল সেদিন।

বিয়ের পরে পরেই ওরা গেছিল কৌসানি। গান্ধী আশ্রমের উঁচু চাতাল থেকে সূর্য ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে দেখছিল সূর্যোদয়ের মুহূর্ত। সূর্য উঠছে। তার আলোয় মুহূর্তে মুহূর্তে বদলাচ্ছে বরফ-ঢাকা পাহাড় চূড়োর রং। সে এক অপার্থিব দৃশ্য ! কী অদ্ভুত একটা অনুভুতি শর্মিষ্ঠাকে নিঃস্ব, শূন্য করে তুলছিল। মাথার ওপর বিশাল আকাশটা তখনও ফর্সা হয়নি, অজস্র তারায় সাজানো। চোখের সামনে রং নিয়ে সূর্যের ওরকম খেলা। শর্মিষ্ঠা জানে না, তার দু’চোখ দিয়ে সেদিন কেন অমন জল ঝরে পড়ছিল ! শর্মিষ্ঠা কাঁদছিল। ক্যামেরা হাতে পাশে দাঁড়িয়ে সুজয়ের হঠাৎ ঐ মন্তব্য শর্মিষ্ঠাকে এক্কেবারে একা করে দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ ছুট্টে ঢুকে পড়েছিল গান্ধী আশ্রমের কাঠের ঘরের বিছানায়।

আজ এতদিন পর, যখন সুজয়ও আর সঙ্গে নেই, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই সব ছোট ছোট ঘটনাকে রোমন্থনে তুলে আনে সে । বোঝে, একাকিত্বের বোধহয় নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে।

ছেলে-বউয়ের সংসারে শর্মিষ্ঠা এখন অন্যরকমের একা। আজ সুজয়ের উনিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। আলতায় আঁকা সুজয়ের পায়ের ছাপ ফ্রেমবন্দি হয়ে ঠাঁই হয়েছে ওর ঠাকুরঘরে। খুব সকালে স্নান সেরে শর্মিষ্ঠা কিছু ফুল নিয়ে সেই সুজয়ের সামনেই দাঁড়ায়। ফ্রেমবন্দি পায়ের ছাপের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর ফুল দেয়। দু’চোখের পাতা ভিজে ওঠে। ডুকরে ওঠে শর্মিষ্ঠা।
মৌমিতা, ছেলের বউ ব্রাশ হাতে বেসিনে যাবার সময় শর্মিষ্ঠাকে দেখে থমকে যায়। তারপর অস্ফুটে বলে, ‘কোনো মানে হয় !’ শর্মিষ্ঠার কানে যায় কথাটা। সে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়।

4 thoughts on “অণুগল্পঃ নিঃস্বতা – স্বপন নাগ

Leave a Reply to Sourav Debburman Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *