আজ বসন্ত
অনিরুদ্ধ সুব্রত
শতবর্ষ উত্তীর্ণ কবি গভীর প্রত্যয়ে লিখেছিলেন, ” ফুল ফুটুক না ফুটুক / আজ বসন্ত ।”
সবুজ হৃদয়ে প্রস্ফুটিত ফুলের আজ যেন সত্যিই অভাব, তবু কবির সঙ্গে বলতে ইচ্ছে করে, “কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে” কেননা পাথরে পা ডুবিয়ে আছে আজকের গাছ, নব প্রজন্মের অরণ্য ।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের গাইতে দিয়েছিলেন, “মোর পরানে দখিনবায়ু লাগিছে” ।
কিন্তু পরক্ষণেই লেখা হয়েছিল ” কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে —” । এই যে “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে ” আজকের দুই হাজার একুশের মধ্য ফেব্রুয়ারির দক্ষিণ বায়ুতে কী শিহরণ আছে ? কী সুখে যৌবনের বনে সুরেলা কোকিল গেয়ে উঠবে ? এ তো প্রকৃতির প্রেমময়তার জাগ্রত দিন, কিন্তু জীবনের ক্ষেত্র যদি হুতাশ দীর্ণতায় হীন থেকে হীনতর হতে থাকে সময় ! যদি একটা দেশ জাতি পদে পদে নব যৌবনের , নব মুকুলের প্রতি কেবল অনীহা আর অবহেলাই রাখে ! যদি খেয়াল না থাকে তরুণ প্রজন্মের কথা !

পাতা ঝরা আড়ষ্ট শৈত্য পেরিয়ে নব মুকুলের আগমনের যে উদযাপন, এই যে সেজে ওঠা ফাগুনের আগুন পোহাবার যে মুহূর্ত, সেখানে আনন্দ কোথায় ? প্রকৃতি হৃদয়ে যে ছুঁয়ে দেবে রং তার জন্যে একটা শ্বেত শুভ্র মানসিক সুস্থ দেয়াল যে দরকার, তার ঠিকানা কোথায় ?
অতীমারি পেরিয়ে যে পথের সন্ধানে উৎসুক হয়ে প্রহর গুনছিল এই দেশ তথা রাজ্যের কয়েক কোটি বেকার ,যুবক, তরুণ তাদের সেই জীবন-বসন্তের দখিন দ্বার আমরা খুলে দিতে পারলাম না । এমন এক দেশীয়-প্রকৃতির মধ্যে আজ ঋতু বদল হতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই জীবনের দুর্ভাগ্যের পরিস্থিতি কোনও ভাবেই বদলায় না । বাজেট বক্তৃতায় একটা রোগা কোকিল অন্তত ডেকে না উঠলে, চাকরির প্রান্তরে একটু একটু পলাশের কুঁড়ি দেখা না দিলে আসল বসন্ত যে অধরা থেকে যায়, রাষ্ট্রের ঈশ্বরদের সে বোধ কবে জাগবে।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের চাঁদ একদিন রুটির বিভ্রান্তিতে ট্রাজেডি তৈরি করেছিল, কিন্তু সেই পথ হাঁটা আজ যেন নতুন করে বিপন্নতার দিকে প্রবল ধেয়ে চলেছে। তাই স্বপ্নের, সাধের, প্রেমের মধুচন্দ্রিমা ছোঁয়ার গল্প গুলো বড্ড ক্লিশে লাগে। ফলে বসন্ত আসে, যায় অথচ মন যেন কিছুতেই বদলায় না। সপ্ত বর্ণের রঙধনু স্বতন্ত্র অনুভব দিতে পারছেনা সিংহভাগ যৌবনের বনে। বসন্ত আসলেই সেখানে ফুলের দেখা নেই ।
বরং ভোট এলে এদেশে রঙিন আতসের মতো এক বৈচিত্র্যময় বসন্ত আসে । প্রচার বিজ্ঞাপন তো ছিলই, এসেছে দল বদলের চমক, ডিজিটাল বক্তৃতার ফুল ফুটছে ভার্চুয়াল দেয়ালে । রঙ বেরঙের পোশাকে, পতাকায়, শ্লোগানে আর প্রতিশ্রুতির মিছিলে সরগরম হয় রাজপথ । সেই মাইক্রোফোন অধ্যুষিত বসন্তে সাধারণ মানুষের জীবনে বরং প্রেম হারিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। সেখানে রাতারাতি জায়গা করে নেয় হিংসা, প্রতিবাদ, পাল্টা প্রতিবাদ অথবা লাঠিচার্জ । সরকার পক্ষ বা বিরোধী কেউই তখন ঝিরঝিরে দখিনা বাতাসে ভাসে না। সে যত সুন্দর ফাগুনের আগুন রঙের দিগন্ত হোক ।
প্রকৃতির দানে মানুষের হাত পড়েছে যেদিন থেকে, যেদিন থেকে প্রকৃতির সত্যিকে ঘুরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে সে, সেদিন থেকে মানুষ নিজেই হারাতে চেয়েছে ঋতু, কাল, সন্ধ্যে সকালের দখল। বরং জীবনের সমস্ত রং এখন রাষ্ট্র ব্যবস্থার হাতে। যেন রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে নির্দিষ্ট মাপে বসন্ত পাওয়া যাবে । কোকিলের ডাক শুনতে হলে অমুককে ভোট দিতে হবে, না হলে কাকের ডাক শুনতে শুনতে সন্তান সন্ততিদের শ্মশান থেকে ফিরতে হবে ।
আজ ফাল্গুন বা ফেব্রুয়ারি দুইই জাগ্রত দ্বারে, কাব্য করতে ভালো লাগারই তো কথা । তাদের সুখের দিশা থাকলে বা সম্ভাবনার সুর থাকলে তার থেকে শান্তি আর আনন্দ যাপন প্রত্যাশা করা যায় । প্রকৃতি যে রং নিয়েই আসুখ না কেন, আসলে জীবনের গভীর অসুখের প্রকৃত আরোগ্য না হলে সব আয়োজনই বৃথা । ঈশ্বর হয়তো বোঝেন, মানুষ বুঝবে কবে !
—– অনিরুদ্ধ সুব্রত ১২ / ২/ ২১
সঠিক বিবেচনা।একমত।