ছোটগল্পঃ সসম্মানে যেতে দাও – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

সসম্মানে যেতে দাও
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

শবযাত্রায় হৈ হৈ আনন্দ চাই, ফুল ইস্পিড “ছোটা হাতি” চাই, লুচি মিষ্টি মদ… রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যায় ইরার। যতদিন ঠাকমা বেঁচে ছিল ততদিন কী কষ্টেই না কেটেছে বেচারার। বিছানায় লেপ্টে পড়ে থাকা, খিদে পেলে চোখ দুটো জ্বল জ্বল করত। দেরি হলে চোখের জল গড়িয়ে পড়ত গালে। বাবা একবার সকালে দোকানে যাবার আগে এসে দাঁড়াত। তখন ঠাকমা বহু কষ্টে জড়ানো জিভ দিয়ে লজেন্স চাইত। কোনোদিন গুড় বা পাটালি। বেচারা মিষ্টি খেতে কী ভালই না বাসত।বাবা অনেক কষ্টে সেসব বুঝে নিত। কিন্তু ইরা সব বুঝতে পারত। সেই ছোট্ট বেলা থেকে ঠাকমার সাথেই তো কেটেছে। মা তো সংসারের কাজ কর্ম, টি ভি দেখা আর গল্প গুজব নিয়েই কাটিয়ে দিল। প্রাইমারির কত পড়াই তো ঠাকমা পড়িয়েছে। ঠাকমা যতদিন সক্ষম ছিল নিজের কাজ ছাড়াও সংসারের প্রচুর কাজ করত। মাকে নানা কাজে সাহায্য করত। কত সুন্দর সেলাই করত ঠাকমা। বাড়ি ভর্তি ঠাকমার হাতের কাজ। মাকেও কত সেলাই শিখিয়েছে। রান্না বান্না পিঠে পায়েস সবই তো ঠাকমার কাছে শেখা। ইরা আর অরুকে তো ঠাকমাই বড় করেছে। সুন্দর করে গল্প বলত। রামায়ণ মহাভারতের গল্প সবচেয়ে ভালবাসত। ঠাকমা পড়াশোনায় ভাল ছিল বলে ঠাকমার বাবা তাকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়িয়েছিল। কিন্ত ঠাকুরদার পরিবার এক্কেবারে গোঁড়া আর নির্বোধ।
মাও তো চাকরি করত একটা যেমনই হোক প্রাইভেট স্কুলের অফিসে। ঠাকুরদা গজর গজর করে সেটা ছাড়িয়ে দিয়েছিল। ঠাকমা নাকি মাকে হাজার বার নিষেধ করেছিল। শয্যাশায়ী হবার পর ঠাকমার সাথে মা’র সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ইরা খেয়াল করে দেখেছে ঠাকমা কিছু চাইলে মা সেটা দিচ্ছি দেব করে এড়িয়ে যায়। এসব নিয়ে এই দু’বছরে বহু ঝগড়া হয়েছে। অরুটাও সে রকম, পড়াশোনা করে একটা স্বার্থপর ছেলে হয়েছে। ছ সাত মাস অন্তর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে আসে আনন্দ করে চলে যায়। অথচ অরুর পড়াশোনা এতদূর হতোই না ঠাকমা যদি না বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করাতো। এখন ঠাকমার দৌলতে ম্যানেজমেন্ট পড়ে বাবু বিশাল চাকরি করে দিল্লিতে। হুইল চেয়াটের খরচটাও দিল না। যা করার ইরাই করল। সপ্তাহে তিনদিন ইরা আর রমাদি কোনোমতে ধরাধরি করে বসিয়ে বেল্ট বেঁধে একটু ঘর থেকে বার করত। শেষেরর তিন চার মাস আর ঠাকমা পারতনা। ইরার বিয়েওতো অমলের সাথে হতো না। একে এক গাঁ তায় অসবর্ণ। ঠাকমা নিত্য মা আর বাবাকে
নানা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল এমন কী অমলের মা বাবা আর জ্যাঠাকে বোঝাতে মুখে প্রায় ফেনা তুলেছে। তবে ইরার সরকারি চাকরিটা অনেক বরফ গলিয়েছে। দুই ভাইবোনের পড়া শোনার খরচ জোগাতে বাবা যখন হিম সিম খাচ্ছে তখন নিজের হার বালা চুড়ি সব বিক্রি করতে দিয়েছিল বাবাকে।
মানুষটা বিছানা নিতেই বোঝা হয়ে গেল! কাকাকে তো বাবা মা এক প্রকার অপমান করেই তাড়িয়েছে। কাকা শুধু বই পড়ে, রাজনীতি করে,সংসারের কোন কাজে আসে না। অথচ তাদের স্কুলের যাবতীয় ইংরিজি আর অংক কাকাই করিয়েছে। ইরাতো বিরানব্বই স্কোর করেছিল অংকে আর ইংরিজিতে লেটার। অরুও তো স্টারই পেয়েছিল না কি? মানুষ যে কেন এমন একপেশে বিচার করে কে জানে? বাবার ঐ মাঝারি মাপের পারিবারিক দোকান আজ ভালই চলে। প্রায় সবই পাওয়া যায়। কাকাকে কিছুদিন সংগে নিলেও কাকা ঠিক পারছিল না অভিযোগ তুলে তাকে নিরুৎসাহিত করল তো ঐ মা বাবাই। অথচ বাজারে ‘শ্রী ভ্যরাইটি স্টোর ‘এখন রমরমিয়ে চলছে।
ইরা ঠাকমার মৃতদেহের সামনে বসে এসব আকাশ পাতাল ভাবছে। ঠাকমার সাথে থেকেই এমন দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছে সে। ঠাকমা বলত, “যা দেখবি সোজাসুজি দেখবি, নিজের দোষ ঢেকে দেখবি না।” অথচ স্বভাবে এতটুকু কঠিন ছিল না। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল থাকত। কাকাকে যখন চলে যেতে বলল ঠাকমা তখন খুব রাগ হয়েছিল। ঠাকমার যুক্তি ছিল একা পুরুষের পায়ের তলায় পৃথিবী ভয় করলে নিজের পায়ে দাঁড়াবে কী করে? এখন কাকা স্কুল টিচার কাকীমাও তাই। দু-তিন মাস পরপর আসে, ঠাকমার সাথে একতরফা কত কথা হয়। ঠাকমার চোখের কোণের জল মুছিয়ে দেয়। এই তো ইরা এমন ভাবে ভাবছে যেন ঠাকমা এখনো আছে।
অনেক লোক এসেছে গ্রাম থেকে, ঠাকমা ভাল মানুষ ছিল, এসব কথাও হচ্ছে। প্রতিবেশী কাকিমারা আর মায়ের দু একজন বন্ধুও এসে গেছে। কিন্তু কাকা এখনো এসে পৌঁছল না। কাকিমা আবার স্কুল টিচার, দূরে পোস্টিং আসতে সময় লাগছে। ওরা এলেই সৎকারের জন্য যাওয়া হবে। ঠাকমাকে সাজানোও হয়ে গেছে। হঠাৎ তাল ভঙ্গ করলেন মন্টু জ্যাঠা। প্রস্তাব দিলেন শবযাত্রীদের জন্য ম্যাটাডোর চাই, লুচি আলুর দম মিষ্টি চাই যার যত খুশী, তারজন্য ‘ক্যাশটাকা’ নেওয়া হয় যেন। পাশ থেকে বিদু বলে ছেলেটা এই সেদিনও যেটা মাঠে মাঠে আন্ডার হ্যান্ড ক্রিকেট খেলত আর ক্ষিরিশ তলায় বসে বসে মেয়েদের বিরক্ত করত সেটা বলে কিনা “একটু ডিজে হবে না? আমরা একটু আনন্দ করতুম।” ইরার মনে হল ঠাস করে একটা চড় কষায়। ঘর থেকে উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে এল। কিছু বলার আগেই কানাই কাকা অনুযোগ করলেন “তাহলে আমাদের ডাকলে কেন?” “দুটো খোল, করতাল, হারমনিয়ম দুহাজার টাকায় কথা হল, এখন ডি জে হলে তো…। মন্টু জ্যাঠা বাধা দিলেন,”তোমার কি মাথা খারাপ কানাই, শেষ যাত্রায় ডিজে! এ কি দুগ্গোপুজোর ভাসান?” বিদু বলল, “আমি কাগজে পড়েছি একজন ঠাকমার শ্মশান যাত্রায় ডিজে হয়েছে।” বাবা বারান্দার একদিকে গোপাল কাকা আর অরবিন্দ কাকার সাথে কী আলোচনা করছে কে জানে কানে এল ছ’ হাজার টাকা কথাটা। ইরা বুঝতে পারছে না এটা কীসের উৎসব। অমলকেও দেখতে পাচ্ছে না। কখন গেছে বাবা মায়ের জন্য ধুতি শাড়ি কিনতে। ইরার বড্ড একা লাগল নিজেকে। অরু আসতে পারবেনা ওর বাচ্চাটার শরীর খারাপ। কাকাকে আর একবার ফোন করবে না কি? মা সীমা কাকীমার সাথে ঘর সংসারে কী কী ফেলে দিতে হবে তার হিসেব করছে। রমাদি তার রুগীর জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখছে। ইরার হঠাৎ কান্না পেল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কারোর একবারও ঠাকমার কথা মনে পড়ছে না। বিছানায় পড়ার আগে পর্যন্ত যে মানুষটা সবার জন্য ভেবেছে তার জন্য কারো একটু মায়া হচ্ছে না। মন খারাপ হচ্ছে না। ডিজে না হরিনাম,রাম না হুইস্কি, কুড়িজন না পঁচিশজন, রসগোল্লা না সন্দেশ,একটা ম্যাটাডোর না কি সংগে শম্ভুর টাটাসুমো…
রমাদি চট করে ইরাকে ধরে ফেলল। বলল “কি গো শরীর খারাপ নাকি?” ইরা সামলে নিল বারান্দায় এসে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুনুন আপনাদের কেন আনন্দ হচ্ছে জানিনা। আমাদের কারো হচ্ছে না। আমার অনুরোধ আপনারা শান্ত ভাবে নিয়ে যাবেন। তারস্বরে হরিবোল বলবেন না। সৎকার হয়ে গেলে তৃপ্তি করে খাবেন কিন্তু মাতলামি করবেন না। এবার যাদের ইচ্ছে হয় যাবেন যাদের ইচ্ছে হচ্ছে না যাবেন না।”
মন্টু জ্যাঠা কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন কাকার কথায় চাপা পড়ে গেল। কাকা কাকিমা এসে গেছে সঙ্গে তিয়া। ইরা শুনল কাকা বলছে, ” মা আমাদের বড় শান্ত কিন্তু খুব জেদি ছিল। এই আমাকেই ঠেলে বার না করে দিলে আমি হয়তো দাদার বোঝা হয়ে থাকতাম। অমন বিচক্ষণ মানুষটার শেষ যাত্রাটা মর্যাদার সাথেই হওয়া উচিত।”
বিদুর দল উঠোন ছেড়ে বেরতে যাচ্ছিল কাকা তাদের আটকাল বলল “আরে তোমরা কোথায় চললে? এসো এসো কাজ কী আছে দেখি। মৃতকে সম্মান করা মানে তো নিজেদের সম্মান বজায় রাখা। জোর করে আনন্দ হয়? তাও আবার মৃত্যুতে? এসব আমরা চিন্তা ভাবনা করি না বলে চলে আসছে। এসো এসো।”
ইরার একটু আগে যে দম বন্ধ লাগছিল এখন আর লাগছে না। মা ঘরে ঢুকে বলল “ঠিকই বলেছিস রে ইরা, অনেক জায়গাতেই এই অসভ্যতাটা চলছে বিশেষত এই গ্রামাঞ্চলে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।” মায়ের সাথে কত দিন পর তার মতের মিল হল। ইরা দেখল ঠাকমার মুখটা কি একটু বেশি প্রশান্ত লাগছে? চোখে পড়ল উঠোনের শ্বেত করবী গাছটার দিকে কয়েক থোকা ফুল হয়ে আছে। ইরা একটা থোকা পেড়ে আনল, ঠাকমার বুকের ওপর রজনী গন্ধা একটু সরিয়ে শ্বেত করবীর থোকাটা রাখল। মনে মনে বলল, “তুমি আর আমি গাছটা লাগিয়েছিলাম, দেখো কেমন ফুল দিল তোমাকে। ভাল থেকো, ভালবাসি তোমায়।”

One thought on “ছোটগল্পঃ সসম্মানে যেতে দাও – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

  1. খুব সুন্দর।বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন লেখিকা। অভিনন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *