ছোটগল্পঃ মানবিক – ভূমিকা গোস্বামী

মানবিক
ভূমিকা গোস্বামী

বয়স যে হয়েছে তা হাঁটুই জানান দিচ্ছে । বেশ কদিন ধরেই হাঁটুর ব্যথাটা জ্বালাচ্ছে। হাঁটতে  চলতে চিনচিনে ব্যথা। তিন রাস্তার পারে এই  বারান্দাটাই এখন জনসংযোগের একমাত্র পথ।অত্যন্ত ব্যাস্ত রাস্তা। সাইকেল, অটো , রিক্সা , গাড়ি , সবসময় চলে। সকাল সন্ধ্যায় এখানে বসে চা খেতে খেতে পথ চলা মানুষকে দেখে প্রতিমা। ভাল লাগে ওর। তারাও খুশি হয়। যাতায়াতের সময় কুশল বিনিময় হয়। কেউ বলে , কতদিন বাদে দেখলাম। ভাল আছ তো ?
দেখতে দেখতে পঞ্চাশটা বছর  পার করেছে ও  এ পাড়ায়। বিয়ে হয়ে এখানেই এসেছিল । শাঁখ আর উলুধ্বনির সাথে যে মানুষ গুলো চারদিকে ওকে ঘিরে রেখেছিল, তারা আজ প্রায় কেউই নেই। কত নতুন মুখ এসেছে। কতমুখ মিলিয়ে গেছে । কত মুখের একসময়ের সিংহের হম্বিতম্বি বয়সের সাথে সাথে ইঁদুরের মতো চি চি করতে দেখেছে। কেউই যে অনিবার্য নয় বুঝেছে।
কল্যাণ চলে যাবার পর দুই ছেলেই ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ওদের কর্মস্থলে। প্রতিমা যেতে চায় নি। ওর কাছে এটা তো শুধু ইট, কাঠ আর সিমেন্টে গড়া বাড়ি নয়, পঞ্চাশ বছরের ছোট ছোট সুখ, দুখ , হাসি, কান্নায় মেশা স্মৃতির সাক্ষী। ছোট্ট দু কামরার ঘর থেকে এই ফুলে ফলে ঘেরা ছবির মতো বাড়িটা  ওর কত পরিকল্পনা , কত পরিশ্রমের ফসল। তাছাড়া এই পাড়ার লোকজন ওর আপনজনের মতো। সবসময় খোঁজ খবর করে।  প্রতিমাও সকলের সুখে দুঃখে পাশে থাকে। খোঁজ নেয়। সবাইকেই ও ভালবাসে।
শীতের শেষ । সেদিন রাতের খাওয়া হয়ে গেছে।  বারান্দার ইজি চেয়ারে এসে বসেছে প্রতিমা। রাস্তার আলোর রেশ বারান্দায় এসে পড়েছে। বসন্তের মিস্টি হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। ভাল লাগছে ওর। রাস্তাঘাট শুনসান।  হঠাৎ  কানে এল ফিসফিস করে কোন নারী কণ্ঠ যেন কথা বলছে।  শোনার চেষ্টা করলো ও। শুনতে পেল না। এবার পুরুষ কণ্ঠ , শুনতে পেল ও। স্বাভাবিক স্বর। 
— এত ভাবার কী আছে ? এখুনি চল।  জানতে যখন পেরেছে ভালই তো হয়েছে। তাছাড়া আমিও আর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।– কী বলছ ! মেয়েরা বড় হয়েছে। এটা হতে পারে না। তুমি চলে যাও। যা হবার হয়েছে। আর না। এবার বিয়ে করে সংসারী হও।
গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারে প্রতিমা এটা শিবুর বৌ মিনা। 
— বিয়ে তো আমি তোমাকেই করবো। দেখি কে আমায় আটকায়।

লেখাপড়া কম জানলেও বেশ ভদ্র ছেলে শিবু। দিদি বলে ডাকে ও প্রতিমাকে।
রাস্তার আলোয় ও এবার স্পষ্ট দেখল, মিনা হনহন করে এগিয়ে গেল। পিছন পিছন ছেলেটা।
ছেলেটাকেও চিনতে পারল এবার প্রতিমা।  বুড়োদার ছেলে । বাবিন। মিনার দুই মেয়েকে পড়ায়। প্রাইভেট ফার্মে চাকরি পেয়েছে কিছুদিন হল।
বাপ মা মরা এই মিনাকে শিবু বছর পনের আগে বিয়ে করে এনেছিল এখানে। কলকাতার কোন এক কলেজে ফোর্থ ক্লাস স্টাফ শিবু। বাংলাদেশে বাড়ি।  এখানে পিশির বাড়িতে থাকে। নিঃ সন্তান ধনী পিশি আদর করেই বৌকে ঘরে তুলেছিল। মিনাও তো এতদিন বাধ্য বৌ এর মতো সব কাজকর্ম করতো দেখেছে প্রতিমা। 
শিবুর জন্য খারাপ লাগছিল প্রতিমার। সারা সপ্তাহ কাজ করে শনিবার এখানে আসত শিবু। রবিবার থেকে,  সোমবার সকালে কাজে যেত।  যখন আসত, দুহাতে ব্যাগ ভরে বাজার করে আনতো। অনেক রাত পর্যন্ত এইসব ভাবছিল ও। ঘুম আসছিল না। ভোরের দিকে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
পরদিন সকালে বিনির ডাকে ঘুম ভাঙলো ওর। বিনি ওর সব কাজ করে। সকালে আসে রাত আটটায় ওর রাতের খাবার গুছিয়ে রেখে চলে যায়। ঘরে ঢুকেই বলল বিনি –  তুমি এদিকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ। ওদিকে কাল রাতে যে শিবুদার বৌ পালিয়েছে গো, ওই বাবানের সঙ্গে। কিছুক্ষণ  কোন কথা বলতে পারে নি প্রতিমা। 

তিনটে মাস কেটে গেছে এরপর। শিবুর সাথে এরমধ্যে আর দেখা হয়নি ওর। শুনেছে মেয়ে দুটো শিবুর পিশির কাছেই আছে। 
আজ সকালে বিনি এসেই বলল- শুনেছো ?  শিবুদার বৌটা কি করেছে ? কাল রাতে বাবানের মুখে এ্যসিড মেরে শিবুদার কলকাতার বাসায় পালিয়ে গেছে। শিবুদাও নাকি ওকে আবার  ঘরে নিয়েছে। বাবানতো হসপিটালে। বুড়োকাকা পুলিশ ডাকতে চেয়েছিল । বাবান নাকি করতে দেয়নিআরো অনেক কিছু বোধহয় বলছিল, কিন্তু প্রতিমার কানে সেসব কিছুই পৌঁছল না । 
অশিক্ষিত হলেও মানবিক শিবুর জন্য কেবল গর্ব অনুভব হল ওর।

One thought on “ছোটগল্পঃ মানবিক – ভূমিকা গোস্বামী

  1. খুবই সুন্দর কাহিনী‌। শিবুর মত নির্ভেজাল শুদ্ধ মানবিক মানুষ, রক্ত মাংসের মানুষদের মধ্যে খুবই বিরল। লেখিকার সৃজনী শক্তি প্রশংসনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *