বইমেলা কবে আসবে সুপর্ণা !
অনিরুদ্ধ সুব্রত

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হচ্ছে, কিন্তু ৪৫ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০২১ আপাতত স্থগিত । পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী পরবর্তীতে বিবেচনাধীন। এই কথা যখন শহরের ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছি, তখনই একটা রাজনৈতিক মিছিলের চাপে রাস্তা ছেড়ে গলিতে আশ্রয় নিতে হলো । শহর যেন কাঁপছে সেই মিছিলের জনস্রোতে। মাইকে, ফুল-মালায়,ব্যানার ফেস্টুনে আর দলে দলে মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি সাতাঁরে।
এটা আমাদের শহর, তার অভ্যাস আমাদের চেনা, এটা আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাকেও চিনতে হয় পদে পদে। কোভিড পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার বাণী আর সাবধানী তবু যেন মেলে না। ভ্যাকসিন যেন সাধারণের কাছে চাঁদ মামা, কবে যে টি (টিকা) দিয়ে যাবে অজানা । অথচ অনন্ত কালের জন্যে গৃহবন্দি দশায় থাকলে সাধারণের জ্যান্ত জীবন যে মমি হয়ে যাবে— আপামর তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে পথে বেরোতে চেয়েছে। ধাপে ধাপে তোলা হয়েছিল সরকারি ঘোষণার লকডাউন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম, সে তো সোনায় সোহাগা, কিন্তু সব কাজে তার যুক্তি আছে কি ?
হাসনাবাদের লোকটা হাওড়ায় শারীরিক শ্রম না দিলে, কীভাবে বাঁচে ছেলেপুলে নিয়ে ? ফেরিওয়ালা নিজের উঠোনে ফেরি করে কী প্রকারে ? কারখানা না গিয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে কারখানা কি চলে ? নিত্য অফিস যাত্রী শহরতলি, মফস্বল, গ্রাম থেকে শহুরে অফিসে না পৌঁছালে অফিস ঠান্ডা । একদিন শেষে ছাড়া হলো মেট্রো, ছাড়ল লোকাল ট্রেন, লং জার্নিও থেমে নেই । সবই জীবনের প্রয়োজনে, মানুষের বাঁচার চাহিদায়। সাত আট মাসের বন্দি জীবন ধীরে ধীরে নিউ নরম্যাল ।
কিন্তু যে সাবধানতা গুলো ছিল প্রধান শর্ত, তার কতটুকু মানা হলো ? কে রাখছে খেয়াল সে দিকে ? কার নজরদারিতে থাকা উচিত ছিল ? ধীরে ধীরে সে সব প্রশ্ন উত্তরহীন হয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল ।
অথচ ভোটের বাদ্যি বাজাতে বাজাতে দেশ,রাজ্য,শহর মফস্বল, গ্রাম জুড়ে রীতিমতো খুল্লামখুল্লা উৎসব শুরু হয়ে গেল । নেতার কনভয় ছুটে গেল এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । ম্যারাপ বাঁধা মঞ্চে জ্যান্ত হয়ে উঠল সব ঘুমিয়ে থাকা মাইক্রোফোন । কাতারে কাতারে ভোটার ও সম্ভাব্য ভোটারদের ভিড়ে প্রত্যেকেই ভুলে গেল— মাস্ক, স্যানিটাইজার, সোসাল ডিসট্যান্স । যেন ভোটের লালারস পরীক্ষায় সবই উত্তীর্ণ, সবই নির্ভয়।
রাস্তায় বিকেলে, সন্ধ্যায় লম্বা মিছিল নতুবা মোড়ে মোড়ে পথসভা ।পথচলতি মানুষের ভিড়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরও আরও ভিড়ের ভিতরে গণ যাতায়াত । বাজারে বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়া ক্রেতা বিক্রেতার উদাসীনতা ঠেকানোর কোনও ইচ্ছে রইল না আর। পার্কে, পার্টিতে, রেস্টুরেন্টে, বর্ষ বরণের মোচ্ছবে অবাধ চলল সবই । শুধু চুপচাপ একমাত্র স্কুল, কলেজের পড়াশোনা । শুধু ঝুলে থাকল, বই কেনা বই বেচার বইমেলা।
কলকাতা বইমেলা শুধু এই রাজ্যের একটি বৃহত্তর বই-উৎসব নয়, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এই উচ্চতার বই বিহার হয়তো আর একটা নেই । একটা বৃহত্তর সংখ্যার প্রকাশক এবং তার চেয়ে আরও বেশি সংখ্যার বিক্রেতা সারা বছর যে কেনা বেচার দিকে তাকিয়ে থাকেন সেটা একমাত্র কলকাতা বইমেলা । এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষের শ্রম ও জীবিকা । তাদের বিকল্প আর্থিক সহায়তা যদি সম্ভব হতো, তাহলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু ধীরে ধীরে যে পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন বই প্রস্তুতকারী, যে শ্রম কিনতে হয়েছে শ্রমিকদের কাছ থেকে তার গুরুত্বটুকু যৌক্তিকতা দিয়ে ভাবা যেতে পারত। বিশেষত বইমেলায় শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি যতদূর মনে হয় অন্য ক্ষেত্র থেকে অনেক সহজ। উপযুক্ত নজরদারি রাখতে পারলে যে কাজটি অসম্ভব ছিল না ।
অথচ মন্দির, মসজিদ, মেলা, কীর্তন, অনুষ্ঠান সর্বত্র অবাধ জন সমাগম স্বমহিমায় চলছে। পিকনিক থেকে পার্টি মিটিং থেমে কি আছে কিছু ? বিন্দুমাত্র নজরদারি ছাড়াই সে সব চলছে। আর যেখানে নজরদারি বা নিয়মের ঘেরাটোপে বইমেলার আয়োজন সম্ভব বলেই ধারণা হয়, সেখানে আর একটু সহজ বিবেচনা অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল । ফেব্রুয়ারি সরে গেলে প্রাকৃতিক পরিস্থিতির আনুকূল্য কতটুকু থাকবে তা নিয়েও ঝুঁকি থাকে। তাই আশা করব পরবর্তী সিদ্ধান্ত বইমেলার পক্ষেই সফলতা পাবে, এবং একটু দ্রুততার সঙ্গেই ।
![]() |
ভীষণ মূল্যবান লেখা। কোভিডের শত্রুতা যেন শুধু পুঁথিপত্র সম্পর্কিত বিষয়ের সাথে এমনটাই এখন মনে হচ্ছে। সব বন্ধ দুয়ার খুলে গেলে শুধু মরচে ধরছে স্কুল কলেজের তালায়। ৩১ শে ডিসেম্বরের মধ্য রাতে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর যে মোচ্ছব দেখেছি টিভির পর্দায় তার থেকেই বোঝা গেছে কোভিড শুধু সাদা পাতা আর কালো অক্ষরের শত্রু। তাছাড়া সামনে আরও বড় উৎসব। ভোট উৎসব। তাই এখন বঙ্গবাসীকে নির্ভয় হতে আহবান জানাচ্ছে নেতা মন্ত্রীরা।
খুব ভাল লেখা।বইমেলা বাংলার সংস্কৃতি। বাঙালির শীতের প্রধান আকর্ষণের অন্যতম বইমেলা। পাশাপাশি আরও অনেক মেলা, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের হাতে তৈরী জিনিস বিক্রির বাজার ও এই বইমেলাকে ঘিরে। সব মিলিয়ে বিরাট ক্ষতি হল।