ছোটগল্পঃ স্বচ্ছ ভারত – মধুপর্ণা রায়

স্বচ্ছ ভারত
মধুপর্ণা রায়

গান্ধী চশমাছাপ। তার ভেতর স্বচ্ছ লিপি –
“স্বচ্ছ ভারত”। টুনি বালবের সেই প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করছে দাদু। নাতি শুনেছে কিন্তুু ঠিক বিশ্বাস হয় নি। দাদুর গা ঘেঁসে বসে তাই আবার প্রশ্ন, ‘কিছু বললে দাদুভাই?’ ‘বলছি.. বড্ড ভালো কাটালাম রে কালী পূজাটা এবার’, গলা ঝেড়ে, সকালের আরমোড়া ভেঙে বললেন নবেন্দু বাবু। ‘বাব্বা দাদু!! এ কি বলছো? গৃহবন্দি কালী পূজা তোমার ভালো লেগেছে! একি বলছো?’, নাতি যেন আকাশ থেকে পড়লো। ‘সে আজকের কথা নয় রে, বুঝলি… আমি তখন ঠিক তোর বয়সি, দাদুভাই। কালী পূজার দুদিন আগে থেকেই মা কে দেখতাম সলতে পাকাতে বসতেন। বাবা যেতেন বাজার থেকে মাটির প্রদীপ কিনতে। কেনার পর, বড়ো গামলায় জল ভরে সেই দীপ গুলো কে অনেক ক্ষন ভিজিয়ে রেখে তারপর উঠোনে শুকোতে দেওয়া হতো। ঘরের কাজ সামলে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই, মা ডমণদা কে সাথে নিয়ে সেই নূতন প্রদীপ এ তেল ঢেলে, সলতে ভিজিয়ে সব তৈরি রাখতেন পরের দিনের জন্য ,’ গলা নামিয়ে শান্ত স্বরে গপ্পো চলছে দাদুর। শান্ত শ্রোতা বুবাই। ‘তারপর?’, প্রশ্ন নাতির। ‘তারপর আর কি? অমাবস্যার আগের রাতে চোদ্দো খানা প্রদীপ জ্বালাতে দেখতাম মা কে। সে কি আনন্দ! আমার বড় দাদা .. সেই দাদু কে তুই দেখিস নি, আমার সেই দাদা আর আমার মধ্যে চলতো সকাল থেকে একটা ঠাণ্ডা লড়াই.. ভূত চতুর্দশী রাতে সেই চোদ্দো প্রদীপ দখলে রাখার লড়াই!’ , দাদুর মুখে স্মিত হাসি। ‘কে জিততো দাদুভাই? তুমি, নাকি সেই বড়ো দাদু?’, দুই চোখ ভরা কৌতূহল বুবাই এর। ‘সে বলা মুশকিল। কোনো বার টেন্ডার টা আমি পেতাম, তো কোনোবার দাদা। কঠিন পরীক্ষা। পাস করলে তবেই কিনা পরে পাওয়া চোদ্দো আনার মত, চোদ্দো টি দীপ জেতা যেত!..’ , দাদুর গলায় হারিয়ে যাওয়া উত্তেজনার রেশ। ‘কি পরীক্ষা দাদুভাই?’, ভ্রু কুঁচকে আবারো প্রশ্ন নাতিবাবুর। ‘এ পরীক্ষা তুমি হলে, কোনো দিন ই দিতে পারতে না, কঠিন পরীক্ষা দাদুভাই, ভীষণ কঠিন..’, ফিসফিস করলো দাদুর গলা। ‘আরে ধুর, বলোই না! আমি পারতাম না, তা কখনো হতে পারে? ইম্পসিবল তখনও ঠিক এ প্লাস পেতাম দাদুভাই!’ , জোর গলায় দাবি জানায় বুবাই। ‘তুমি তো একটা শাক দিয়ে ভাত খেতেই কতো হাঙ্গামা করো, আর জানো তো, আমাদেরকে সেদিন, আমাদের মা চোদ্দো রকম এর শাক দিয়ে ভাত খেতে দিতেন! যে যত তাড়াতাড়ি যত পরিষ্কার পাত করে দেখাবে, সে ই হতো সেদিন এর উইনার, তার ভাগ্যেই জুটতো টেন্ডার, চোদ্দো প্রদীপ দখলে রাখার টেন্ডার, , একটা ওয়ার্ল্ড কাপ জিতে নেওয়ার মতো উত্তেজনা হতো তখন!’ , হাসতে হাসতে বললেন দাদু। ও এম জি, দ্যাট ওয়াজ প্রিটি আনফেয়ার, এ ভাবে কেউ পরীক্ষা নেয়? ফোর্টিন টা হারবস খাওয়ার এক্সাম… ইয়াকি!’, মুখ ব্যাজার করলো বুবাই। ‘আরে না দাদুভাই, ইয়াকি কেন হবে? ইট ইউজড টু বি ফান, সবই হ্যাবিট… তারপর সন্ধ্যা নামতেই, উইনার কে চোদ্দো প্রদীপ এর পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হতো: তেল কমলে তেল ঢালা, সলতে সামলানো, আলোর ধারে শ্যামা পোকা খেতে আসা টিকটিকি তাড়ানো, কত্ত কাজ!.. এই করতে করতে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিলেই, ব্যাস আর পড়তে বসতে হতো না!! একি কম পাওয়া? – এবার বুঝলে তো, এই টেন্ডার জেতা কেন বিশ্বকাপ জেতার আনন্দ দিত?’, দাদুতে – নাতিতে আলোচনা শেষে গলা ছেড়ে তখন হেসে নেওয়ার পালা। ‘তারপর? কালীপূজার দিন কি করতে তোমরা দাদুভাই?’, বুবাই জিজ্ঞাসা করলো। ‘ওরে বাবা! সেদিন তো আরেক আনন্দ। একটু রাত করে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। গায়ে হালকা গরম জামা দিয়ে, মণ্ডপে মণ্ডপে মা কালী কে দেখতে আর প্রণাম করতে যেতাম। হাঁটতে হাঁটতে সবার বাড়ির প্রদীপ আর মোম বাতির আলোক সজ্জার তুলনামূলক হিসেব কষা, সে দারুন একটা মজার ব্যাপার!’, জীবন এর ছোটো ছোটো ঘটনা থেকে বড়ো বড়ো আনন্দ জোগাড় করার ইতিহাসের গল্প বলতে গিয়ে, নবেন্দু বাবুর গলায় তখনও খুশির রেশ।
‘এমা! সেকি গো? তোমরা ফটকা ফাটাতে না? ক্র্যাকারস?!’, চোখ গোলগোল করে প্রশ্ন করে বুবাই। ‘ না দাদুভাই, ফাটাতাম না। আসলে তখন আমরা সবাই জানতাম স্বচ্ছ ভারতের কথা, স্বচ্ছ আকাশ বাতাস এর কথা। তখন আমরা সবাই মানতাম রাতের পাখিদের নিশ্চিন্তে ঘুমোবার অধিকারের কথা। দীপাবলি ছিল শুধুই আলোর উৎসব। ….. এত গুলো বছর পর সেই নিখাদ আলোর উৎসব কে ফেরত পেলাম। একি কম পাওয়া? বড্ড ভালো কাটালাম রে কালী পূজাটা এবার।’ – দাদুর চোখে দীপাবলির আলোর ঝিলিক।

5 thoughts on “ছোটগল্পঃ স্বচ্ছ ভারত – মধুপর্ণা রায়

  1. সত্যিই এবার যেন স্বস্তি ছিল দেওয়ালী উৎসবে‌।
    ভালো লেখা।

  2. কলকাতার বয়স্কজনেরা এবার দীপাবলীতে স্বস্তি অনুভব করেছেন ও অন্য বারের তুলনায় দীপাবলী উত্তর সময়ে সুস্থতর ছিলেন।
    লেখার জন্য ধন্যবাদ।

    1. 🙏😊
      আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগলো 😊।

  3. ভীষণ ভালো লাগলো লেখাটা। সত্যি এবারের উৎসব শুধুই আলোর ছিল। ভীষণ উপভোগ করেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *