ছোটগল্পঃ অ্যাচিভমেন্ট – অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত (কলকাতা)

অ্যাচিভমেন্ট
অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত

পত্রিকাটা এসেছিল গতকালের ডাকে। স্টোরিটা বেরিয়েছে। কথাও ছিল সেরকমই। তবুও এত বড়মাপের পত্রিকা, বিশ্বজোড়া পাবলিকেশান, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রবাসী বাঙালিদের হাতে পড়বে তার লেখা, এটা ভেবেই বেশ উত্তেজনা হচ্ছে । বার বার পাতা উলটে নিজের লেখাই নতুন পাঠকের মত পড়ছে। বুধন কাকার ছবিগুলোও বেশ হয়েছে। ‘সিরজাম ‘ খামার বাড়ির গেট ধরে, পুকুর পাড়ে মাছের চার দেওয়া, খামারের অতন্দ্র প্রহরী কালুসোনা আর তার ছানাপোনাদের সাথে, বীজতলায় পালং ফুলকপি, বাঁধাকপির চারার সারির মাঝখানে, ফুলবাগানের সূর্যমুখীর বীজ হাতে, ট্যুরিস্ট লজের মাটির বাড়ি সব এসেছে অবধারিত ভাবে। এদের নিয়ে বুধন কাকা র সংসার। খামারের অন্য সচল সদস্যরাও আছে ছবিতে। মিঠি, চন্দনা, অনন্ত, শঙ্কর, মুনিয়া, পর্বত দের ডেকে এনে তোলা হয়েছে ছবি! তবে সমস্ত কাজটার কেন্দ্রবিন্দুতে যে আছে, তাকে রাজী করাতে কি কম কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে?

কলকাতা থেকে খিরাইজুরির রাস্তা গাড়িতে পাক্কা ছ ঘণ্টা, তিন তিন বার আসতে হয়েছে নন্দিনীকে, তবে ক্যামেরার সামনে আসতে রাজী হয়েছে বুধন কাকা। অফিস থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম, তারপরেই বেরিয়ে পড়া রাতের অভিযানে। রাতের শহর, শহরতলী, আধাশহরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছে প্রত্যেক জায়গার চরিত্র সে সময় আলাদা আলাদা। এটা নিয়েও লেখার ইচ্ছে আছে তার। অন্ধকারের নৈঃশব্দের মাঝে ছুটে চলার যে কী আনন্দ, তা যে এই স্বাদ পেয়েছে, সে জানে। কলকাতা-দিল্লী হাইওয়ে ছেড়ে গাড়ি যখন গ্রামের পথে পড়ে, ভোরের আকাশে তখন সবে রঙ ধরেছে। সারা রাত গাড়ি চালানোর পর খিরাই ব্লকে ঢুকেই ক্লান্তিতে মনটা চা চা করে। কিন্তু তখনো ঘুম ভাঙেনা গ্রামের। যদিও এভাবে নৈশ ভ্রমণে যাওয়ার জন্য ঋক, রঞ্জুর কাছে বকুনিও খেতে হয় তাকে। বাধ্য মেয়ের মত চুপ করে শোনে সে, উপভোগও করে। ওরা ছাড়া বকুনি দেওয়ার আর আছে তার বোন টুটুল, সে আবার দিদির জন্য যা টেনশান করে, কেঁদেই ভাসাবে হয়তো জানতে পারলে।

ভেবে দেখতে গেলে শুভেন্দু যখন চলে গেল, ঋক আর রঞ্জু দুজনেরই তো তখন স্কুল জীবন। মনের ওপর পাথর চাপিয়ে লড়াই আর লড়াই করতে হয়েছে সে সময়। মাথার ওপর বাবা ও নেই, মা আর টুটুল তখন পাশে না থাকলে দিশেহারা হয়ে যেত সে। এত চড়াই উতরাই তে একটা কথা সে বুঝেছে, জীবনে চ্যালেঞ্জ যদি আসে, লড়াই টা ভাল করেই লড়তে হয়। অলৌকিক কিছু হয়না। আর সেই লড়াই তে প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙে ভেঙে গড়তে হয়। এই ভাঙা গড়ার খেলায় যেন নিজেকেই কোথায় হারিয়ে ফেলেছে নন্দিনী। নইলে চিরকালের মুখচোরা যন্ত্রপাতি নিয়ে অস্বস্তিতে পড়া মেয়েটা আজ যন্ত্রযান টাকে নিয়ে যা খুশি তাই করার ক্ষমতা পেল কীভাবে? যাই হোক, সে সময় টা পেরিয়ে এসেছে সুখে দুঃখে। এখন ছেলে কর্মসূত্রে পুণে, আর মেয়ে ডাক্তারীর পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট পড়তে দিল্লীতে চলে যাওয়ার পর আর পিছন দিকে তাকায় না সে। নির্জন আবাসে বিনিদ্র রজনী এপাশ ওপাশ করার চেয়ে একাকী ছুটে চলাই শ্রেয় !

গত বছর পুজোর সময় এসেছিল সুমিতা, অধুনা টেনেসির বাসিন্দা। তাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল খামারে। বুধন কাকা র সাথে আলাপ ওখানেই। কথায় কথায় তার গল্প, জরুরী অবস্থার সময় বাবার জেলে যাওয়া সব কথাই হয়। সুমিতা শুনে তখনই বলেছিল তোকে একটা পত্রিকা পড়তে দেব। তুই এসব মানুষের কথা ওখানে লেখ। পরদিনই সৌমিত্রর ফোন মেরিল্যাণ্ড থেকে। ওখানেই ফিজিক্সের অধ্যাপনা, আর বাকি সময়টা একটা পত্রিকার সম্পাদনা নিয়ে মেতে থাকা। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের সহপাঠী তার। যে পত্রিকার সম্পাদনা ও করে, সেটা নাকি বিশ্বের যত সফল মানুষ তাদের গল্প মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়, পত্রিকার নাম ‘ অ্যাচিভমেণ্ট’। তবে এদের মাপকাঠিতে অ্যাচিভমেণ্ট’ টা একটু অন্যরকম। তথাকথিত লেখাপড়ায় ভাল ছেলেমেয়ে, পাশ করা, দুর্দান্ত চাকরি, বিদেশে বাস, অথবা বছরে দু তিনটে বিদেশ ভ্রমণ, মই দিয়ে ওপরে, আরো ওপরে আকাশ ছোঁওয়ার চেষ্টায় যারা ঘাম ঝরায় তারা এখানে স্থান পায় না। স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটা লোকজন যাদের কাজ প্রাণিত করে মানুষ জনকে, মানুষের সাথে, প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক সুন্দর করে, তাদের কথা লেখা হয় এই পত্রিকায়। সৌমিত্র চায় বুধন কাকা র জীবনের কথা নিয়ে স্টোরি হোক ওদের পত্রিকায়, লিখুক স্বয়ং নন্দিনী, এই ঘটনার রূপকার যিনি তাঁর সাথে যখন নিবিড় যোগ তার! সব ঘটনাই চোখের সামনে দেখা। হ্যাঁ, কোন ঘটনাই তো অজানা নয়, সেই থেকে বুধনবকাকা র সাথে ওদের পরিবারের যোগাযোগ। তবুও বাবার কাছে শোনা কাহিনীটাই ও লিখবে না, বুধন কাকার স্মৃতি থেকে বাবার কথা, তার নবজন্ম এসব শুনবে, তারপর স্টোরি হবে।

তারপর থেকেই নিয়ম করে ছূটে যাওয়া সপ্তাহান্তে, রবিবারে কাজ সারা হলে আবার সোমবার ওখান থেকে সারাসরি অফিস।

ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের নির্দেশে যখন জরুরী অবস্থা জারী করে নির্বিচারে মানুষ জনকে ধরপাকড় চলছে, সেই সময় বাবাও আটক হলেন ‘মিসা’ তে, কারণ সম্পূর্ণ অজানা। সেটা খুব খারাপ একটা সময় গেছে, তাদের পরিবারের পক্ষে। পরে মা বলেছিলেন বাবা নাকি সরকারের পক্ষে বিপদজনক ছিলেন, তাই তাকে আটক করা হয়। প্রেসিডেন্সী জেলে বাবা ছিলেন প্রায় এক বছর। সেটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, কত নিয়মের বেড়া ডিঙিয়ে তবে বাবার দেখা পাওয়া। বড় ঘরে অন্য অনেকের সাথে বাবাও থাকতেন, কিন্তু মাথায় পিঠে পাওয়া যেতনা তাঁর হাতের কাঙ্খিত স্নেহের ছোঁওয়া ! টুকরো সাংসারিক কিছু কথা, মাপা হাসি, মাপা কথা, মাপা সময় – বাবা কে বৃথাই খুঁজে বেড়াতো নন্দিনী বুকের কাছে ঠেলে ওঠা কান্না চেপে রেখে। বাবা মানুষ টাই এমন ছিলেন যে কিছুদিনের মধ্যে জেলারের সাথেও তার আলাপ হয়ে গেল, মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে সমস্ত প্রোটোকল ভেঙে তিনি গল্প করতেও আসতেন। বাবা তার কাছে আবদার করে আনিয়ে নিয়েছিলেন তার সাধের সেতারখানা। জেলের মধ্যে অতটা সময় বই পড়া আর বাজনা নিয়ে কেটে যেত। দেখা করতে গেলে বাবা বলতেন জেলের মানুষজন কতটা খুশি হচ্ছে বাজনা শুনে! সেই সময়ে একদিন বলেছিলেন বুধনের কথা। তখন সে একটা সংখ্যা মাত্র, নাম জানতেন না। সে নাকি কুখ্যাত খুনের আসামী, কিন্তু যখন বাজনা শোনে, মাথা নিচু করে চোখ বুজে শোনে, আর মাঝে মাঝে কাঁদে। বাবার আকর্ষণে কদিনের মধ্যে যে আরো কাছাকাছি সে চলে আসবে, তা আশ্চর্যের ছিলনা মোটেই! সেই থেকে একটা মানুষের আস্তে আস্তে বদলে যাওয়াটা বাবা লক্ষ করেছিলেন। নন্দিনী গিয়ে জানতে চাইল ওই কয়েদীর কথা – খুনের আসামী কেমন দেখতে, কীভাবে কথা বলে – ওদের ছিল অদম্য কৌতুহল আর ভয়! ভয় করত বাবার জন্য, যদি কিছু করে বাবার সাথে! একদিন সে কথা বাবাকে বলাতে তিনি গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন কোন মানুষ কেই এতটা ঘেন্না বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অনেক অপরাধই মানুষ করে ফেলে যা সে আসলে করতেই চায়নি। সে ওখান থেকে হয়তো বেরতে চায়, কিন্তু পারেনা। সেই অবস্থা থেকে যদি তাকে বার করে আনা যায়, সেটাই সব থেকে বড় কাজ। সেই কথাটা নন্দিনী কখনো ভুলতে পারেনা।

বুধন কাকা কে যখন সব বলা হল, সে তো কিছুতেই রাজী নয় নিজের মুখে সেসব কথা বলতে। বিটিয়া দিদি কে সে বলে, তুমিই লিখে দাও না, জানই তো সব। আমি দেব্তা মানি তোমার বাবা কে। সে ছাড়া এই খুনির আাসামীকে কে তুলে আনত পাঁকের থেকে? তোমার মত লিখে দাও, আমি বলতে পারিনা অত ! নন্দিনীও ছাড়বার পাত্রী নয়, আর তার আগের অন্ধকার জীবন সম্পর্কে সে বেশি কিছু জানেও না। বাবা ছিলেন আলোর কারবারি, তিনিও অন্ধকারে উঁকি মারতে চান নি কখনো। অনেক চেষ্টার পর যা শুনল নন্দিনী তা সত্যিই গল্পেরই মত।

অভাবের তাড়নায় স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে এসেছিল একটা কিশোর, শহরে এক আপাতভাবে স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত বাড়িতে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই সে বুঝতে পেরেছিল সেই বাড়ির লোকজন ঠিক স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনার মানুষ নয়। অথচ যতই অভাবে থাকুক প্রকৃতির কোলে মাটি জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সেই ছেলেটির জীবনে কিছু নিয়ম, কিছু মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে, কেউ না শেখালেও। অন্যায় দেখলে রক্ত ফুটতে থাকে তারও। যে বাড়িতে সে থাকত সেই বাড়ির এক বৃদ্ধার প্রতি অন্যায় আর অত্যাচার সে চোখের সামনে দেখতে দেখতে পুঞ্জীভূত রাগ একদিন আর বাঁধ মানলনা। কী হয়ে গেল – সে বাড়ির দুই ছেলের খুন হয়ে গেল তার হাতে। কিছুক্ষণ সেই মৃত্যুপুরীর মধ্যে বিহ্বল হয়ে থাকার পর যখন বুঝল এর পরিণতি কী হতে পারে তখন পলায়ন টাই ঠিক মনে করল। সে চাইছিল ছুট্টে তার আপুঁই আর আয়ুর কাছে যায়, তার নিজের গ্রামে পালিয়ে যায়। কিন্তু বিধি বাম। পুলিশের হাত থেকে বাঁচবার জন্য যেখানে গিয়ে পড়ল, সেখানে কেউ বাঁচতে যায়না। বহুকালের শ্যাওলা ধরা সিঁড়িতে পা পড়লে যেমন পতন টা ঠিক কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারেনা! তেমনি সেও তারই অঞ্চলের একজনের হাত ধরে ঢুকল সেইরকম জগতে, অবনমনের অতল গর্ভে। তারপর আর ভাবতে চায়না বুধন। চলতে লাগল আলোর বিপরীতে পথযাত্রা। মাদক পাচারকারী দের থেকে গিয়ে পড়ল এক রাজনৈতিক নেতার হাতে। সেই দলে নাম লেখানোর পর তার কাজ ছিল ‘অ্যাকশান’ করা। হাটে বাজারে বোমা ফেলার সময় ও বলে দিতে পারত কটা লাশ আজ নামবে। মানুষের হাহাকার আর্তনাদ এক সময় খারাপ লাগলেও পরে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। তারপর যে কার দলে নাম লেখালো তা সে নিজেই জানেনা। মালিক কে দেখেনি কখনো। শুধু নির্দেশ আসত, মানুষকে নিকেশ করার অমোঘ সেই নির্দেশ অমান্য করা যায় না, ওখানে একবার ঢুকলে নিজের চিন্তা ভাবনা টা বিসর্জন দিতে হয়। ফেরার রাস্তা নেই, শুধু তার আপুঁই, তার বাবা, তার সংসারে না খেতে পেয়ে মরাও ছিল ভাল।

এভাবে মরে বেঁচেই হয়তো কেটে যেত বা মাঝপথে যতি পড়ে যেত জীবনে, যদি সে ক্ষণিকের অসাবধানতায় পুলিশের হাতে না পড়ত! মনে আছে ধরা পড়ে লক আপে চালান হওয়ার পর খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিল। চুপ করে বসে থাকত, মার খেলেও উত্তর দিতনা, আর রাগ জমা করত মনের ভিতর- সবার ওপর রাগ, তার আইয়ু, আপুঁই, তার গ্রাম, অন্ধকার জগতের মানুষ গুলো, সেই বৃদ্ধার দুই ছেলে যাদের দিয়ে তার হাতেখড়ি। সবাই কে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করত। কোমরে দড়ি পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত কোর্টে। লোকজন যেন সার্কাসের খেলা দেখত! তারপর যেখানে গেল সেই জেলেও গণ্ডগোল করে ফেলল আবার। আসলে ভিতরে এত রাগ চেপে চুপ করে বসে থাকা যায় না। প্রকাশ পায়, তখনই ভুল হয়ে যায়, অপরাধ বাড়ে, তার সাথে শাস্তিও। তারপর আসা বড় জেলে – নাম প্রেসিডেন্সি জেল। এখানের সব কিছুই বড়, অপরাধীরা তারই মত বড়,নিয়ম কানুন বড়বড়, কাজের পরিমাণ ও বড়। আবার রাগ জমতে শুরু হয়েছিল বুধনের। হয়তো এখানেও কাণ্ড ঘটিয়েই ফেলত। যদিনা একদিন ভোর হতে না হতেই একটা সুর তার সব কিছু ওলট পালট করে দিত। একটা সুর – যেন কতকালের চেনা! কোথায় শোনা? সে কি তার গ্রামের বামনি ঝোরার জলের বিভঙ্গে? না কি নীল দিঘীর পাখির কিচিমিচিতে? অথবা ঘাটরাঙামাটির পথে পরবের সময় গ্রামের বিটি বউদের মাদল বাজানো গানে? সে যেন বহুকালের ঘুম ভাঙানিয়া গান এল জীবনে, এমন টাই মনে হয়েছিল তার।

তারপরের আর এক লড়াই, সেই সুরের সন্ধানে সে এমন ব্যাকুল হল যে স্বয়ং জেলার ব্যবস্থা করলেন যাতে রাজনৈতিক বন্দীদের ব্লকে ফুল বাগান আর মাটি কোপানোর কাজে তাকে নিয়োগ করা যায়। তবে শর্ত ছিল এত গুরুতর দাগী আসামীর কোমরে থাকবে শিকল। তাই হোল, এরপর তো সে ক্রমাগত আলোর পথেই হেঁটেছে। প্রথম যেদিন ঈশ্বর, বুধনের ভাষায় চাঁদোবঙ্গা – সেই বাবুকে সে দেখল তখনই সেই হাসি মুখ তার মন জয় করে নিয়েছিল। গ্রামের দেশে হাঁড়িয়ার পরবের সময় সেই তো মাদলে তাল তুলত। ছন্দের পূজারী ছিল সে। বাবুর কোলে মা সরস্বতীর হাতের বাজনার মত একটা বাজনা, হাত ছোঁয়ালেই যেন ঢেউ ওঠে। মন দিয়ে শুনত মাটিতে বসে, বাবু ঘরের জানালার কাছে৷ শুধু কি সে? জেলের আসামীদের অনেকেই এসে ভিড় জমাতো সেখানে। বাজনার সাথে সাথে অবাক চোখে তার পরিবর্তন ও দেখত বোধহয় !

নন্দিনী বাবার কাছেও শুনেছে বড় হয়ে এই বুধন, ৩০৮ নম্বর কয়েদী, সে জেলের মধ্যে এক নিঃশব্দ বিপ্লব করল। বিপ্লবটা হল তার মনোজগতে। কথায় কথায় ভাঙচুর করা একবগ্গা মানুষ টা আচরণে বদলে গেল। এবং সঙ্গীতের আবেশে হল এই বদল, সুরের হাত ধরে। ঘটনাটা এতটাই বিশেষ ছিল, যে মনোবিদ এক ভদ্রমহিলাও এলেন ৩০৮ এ-র সাথে কথা বলতে। পরে তিনি বাবা র সাথেও কথা বললেন। তার অনুরোধের আগেই বাবা নিজেই একটা কর্তব্য হিসাবে দেখেছিলেন বিষয়টা, একজন মানুষ যে ডুবন্ত, তার হাত ধরাটা বাবার স্বভাবই ছিল। নন্দিনী জানে তার বাবার মূল্যায়ন তার পার্টিও করতে পারেনি। কঠোর নিয়মানুবর্তিতাই একটা পার্টির একমাত্র বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। মানুষ নিয়ে চলা যখন, তখন মানবিকতাও থাকতে হবে। সুন্দর ব্যালান্স ছিল এব্যাপারে তাঁর, আর সেটাই ছিল পার্টির না পসন্দ। তাই তো শেষ জীবনে কিছু মতের পার্থক্য হওয়ায় সরে এসেছিলেন ওদের থেকে।

বাবার এক বছরের কারাবাসের অনেক অভিজ্ঞতাই গল্প হতে পারে, লেখা আছে বাবার ডায়রীতে, নন্দিনীর ইচ্ছে আছে অবসরের পর তাকাবে ওই দিকে। তবে সব থেকে উজ্জ্বল বোধহয় বুধন কাকার রূপান্তর, বাবার কাছেও এক পরম প্রাপ্তি । মনে করিয়ে দেয় ফ্রান্জ্ কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ এ-র কথা। সেটা অবশ্য রূপকধর্মী, একটু শ্লেষাত্মক। কিন্তু এখানে সমস্ত রাগ শ্লেষের অবসান। একেবারে পালটে যাওয়া, না কী উৎসে ফিরে যাওয়া, ফিরে পাওয়া নিজেকে?

বাবাদের কারাবাস শেষ হল সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর। বাবারা যতজন মিসায় আটক হওয়া বন্দী ছিলেন সবাই ৩০৮ নম্বর কয়েদীর শাস্তির মেয়াদ কমানোর আবেদন করেছিলেন।
সে আবেদনে ততকালীন কর্তৃপক্ষ কান দিয়েছিলেন কিনা তা খোঁজ নেওয়ার মত অবস্থা ছিলনা। জেলের বাইরের লড়াই টাও তো কম কঠিন ছিল না। সরকারী চাকরী থেকে বরখাস্ত, বড় সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা সব চিন্তাই ছিল। রাজনৈতিক দিনবদলের গান তখন সবার গলায়, কিন্তু সাথে যে দায়িত্বও যে বেড়ে গিয়েছিল বাবার। চাকরী ফিরে পেলেন, সংসার ছন্দে ফিরল। বোন শিঞ্জিনী ওরফে টুটুল তখনও পড়াশোনা শেষ করেনি। নন্দিনী অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি তে এম. টেক করে সে বছর একটা চাকরী পেল, আর দীর্ঘদিনের সহপাঠী শুভেন্দু চলে গেল টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে। যাওয়ার আগে দুটো পরিবারের কাছে ওদের বিয়ের পরিকল্পনার কথা জানানো হল। বাবার রিটায়ারমেণ্টও হল সে বছরেই।

এক সকালে নন্দিনী অফিসে বেরনোর আগে বারান্দা থেকে দেখতে পেল গেট খুলে কুণ্ঠিত পদক্ষেপে একজন গ্রাম্য আদিবাসী চেহারার লোক আসছে বারান্দার দিকে। বাবার খোঁজ করতেই বারন্দায় নিজেই বেরিয়ে এলেন বাবা। প্রথম দর্শনে চিনতে না পারায় সেই লোক টি নিজেই পরিচয় দিল। শোনামাত্র বাবা বাইরে বেরিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে এলেন তাকে, সকলের সাথে পরিচয় করালেন। জেল থেকে বেরনোর পরতো দশটা বছর কেটেছে মাঝখানে। সেই প্রথম বহুশ্রুত কয়েদী নম্বর ৩০৮ কে স্বচক্ষে দেখা। জানা গেল কয়েক সপ্তাহ আগে ছাড়া পেয়েছে জেল থেকে। তখন বেশ সংশয়ের মধ্যেই ছিল সবাই। যতই হোক, এতগুলো অপরাধ যার হাত দিয়ে হয়েছে তাকে এতটা প্রবেশাধিকার না দেওয়াই ভাল। সত্যি কথা বলতে কি, তারা দুই বোন বিরোধীই ছিল, কিন্তু মূলত মা বাবার আগ্রহে তার ক্রমশ হয়ে ওঠা আজকের ‘বুধন কাকা’, ওদের পরিবারের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা।

বুধনের সাথে মেলামেশা নিয়ে বাবা অবিচলিত বিশ্বাসে বলতেন, যে লোক একবার সঙ্গীতকে অবলম্বন করে বেঁচে ওঠে, তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, অবিশ্বাস তো নয়ই। এটা একজন কমিউনিস্টের মুখে অনেকেরই বেমানান লেগেছিল সেদিন। কিন্তু বাবার রাজনীতি আর মানব নীতির ব্যালান্স ছিল অনেকেরই ব্যাখ্যার বাইরে।

জেল থেকে বেরিয়ে বুধন গ্রামে গিয়েই বুঝতে পেরেছিল সেখানে তার আর জায়গা নেই। তার পরিবারই নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে। কেউ খবর রাখেনি একটা আদিবাসী গরীব পরিবার কিভাবে পুলিশের উতপীড়ন সহ্য না করতে পেরে কোথায় গায়েব হয়ে গেল, আর সেই উতপীড়নের কারণ ও তো সে নিজেই! প্রায় কুড়ি বছরে কত কিছু বদলে গেছে । তার নিজের জীবনই কি কম বদলালো? গ্রামের কেউ তাকে না চিনলেও সে অনেককেই চিনেছে। ওদের দোষ দেওয়া যায় না, তার পরিবার একবারও তার খোঁজ করেনি জেলে এসে। তারা বাদই দিয়েছে তাকে। এখন আর রাগ হয়না তার, কার ওপরই বা রাগ করবে সে! তাই তো আবার চাঁদোবঙ্গা বাবুর কাছেই এল খোঁজ করে করে!

আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম যখন বাবা একদিন ঘোষণা করলেন যে, বাঁকুড়া পুরুলিয়ার বর্ডারে খুব সস্তায় তিনি একটা জায়গা কিনতে চলেছেন। সেই রুক্ষ জায়গায় প্রথমে কয়েক বছর দেখাশোনার করার জন্য বুধন কাকা কে থাকতে দেবেন। সেই উদ্দেশ্যে একটা মাটির ঘরও তৈরি হল সেখানে। নন্দিনীরা সপরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে গিয়েছিল জায়গা টা দেখতে। দেখে এসে মতামত কারোরই বাবা র মতের অনুকূল ছিল না। শুধু রুক্ষতাই নয়, সারা টা জমিতে ছিল কয়েকটা পলাশ গাছ অপুষ্পক উদ্ভিদের মত দাঁড়িয়ে। তাছাড়া সমস্ত জমিটা ছিল শুকনো, ফুটিফাটা, ছোট কাঁটা ঝোপে ভর্তি। একটা শ্রীহীন মাটির বাড়ি, সেখানে থাকার ব্যবস্থা বুধন কাকার। এরকম ব্যবস্থায় কেউই খুশি ছিলাম না, ধরে নিয়েছিলাম এই ভাবে বাবা বুধন কাকা কে একটা থাকবার জায়গা করে দিল মাত্র! বাবা কিন্তু বার বার বলছিলেন, দেখবি ও ওখানে সোনা ফলাবে! বাবা র একনিষ্ঠ সাথী ও সাপোর্টার মা পর্যন্ত বলেছিলেন বেশি বাড়াবাড়ি না করতে।

তারপর তো সবাই দেখেছে, সোনাই ফলেছে পাথুরে রুক্ষ জমিতে। আজ সেটা বেশ বড়সড় নাম ডাক ওয়ালা ‘সিরজাম’ খামার বাড়ি। একদিকে ফুলের চাষ, সূর্যমুখীর বীজ তৈরি করা, অন্য দিকে বীজতলায় সিজনাল তরিতরকারির চারা তৈরি করে সবজি খেতে লাগানো হয়, দুটো পুকুরে মাছের চারা তৈরি করে বড় বড় ভেড়িতে বিক্রি করা হয়, একটা সমবায় কেন্দ্র যাতে গ্রামের মেয়েরা বিভিন্ন শৈলীতে শিক্ষিত হয়ে নিজেদের রুজির উপায় করে নেয়, আর এরই মাঝখানে গড়ে উঠেছে ট্যুরিস্ট লজ, কালো মাটির বাড়ির ওপর গ্রামের মানুষের আঁকা ছবি। মার্চে হোলি, এপ্রিল মে মাসে শিবের গাজন, বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে দিসুম সেন্দ্রা – শিকারের উতসব – বুধন কাকার আগ্রহে, ততপরতায়, আর পরিকল্পনায় মুখর হয়ে ওঠে আদিবাসীদের সমাগমে। খামার বাড়ির এখন পাঁচ বিঘা জমি। বাবা এ-র সবটা দেখে যাননি, মা ও না। তবুও তারা এটা জেনে গেছেন যে মানুষ চিনতে ভুল হয়নি তাঁদের! এই সব কাজের পরিকল্পনায় হয়তো তারা ভাই বোনেরা সামান্য মতামত দিয়েছে, কিন্তু এই খামার বাড়ি বুধন কাকা শুধু আগলে রাখেন নি। এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের অনেকেরই কাজের সংস্থান করেছেন, তাদের পরিবারের ব্যাবসা তৈরি করে দিয়েছেন যে ব্যবসার কোন ধারণা তাদের কখনোই ছিলনা।নন্দিনী, শিঞ্জিনীর বন্ধু আত্মীয় স্বজন দের দেখবার, বেড়াবার একটা জায়গা হয়েছে এই ‘সিরজাম’। নামটাও বুধন কাকারই দেওয়া।

বুধন কাকা নন্দিনীর কাছে জানতে চেয়েছিল ‘অ্যাচিভমেণ্ট’ কথাটার মানে কি? নন্দিনী তাকে মানে টা বুঝিয়ে বলার পর আবার অনেকদিন বাদে তার জীবনের চাঁদোবঙ্গার কথা মনে করে চোখের জল ফেলল বুধন কাকা। তার ভাষাতে যা বলল তার মানে দাঁড়ায় যে এই অ্যাচিভমেণ্ট তার না, এতো বাবুর কীর্তি, বাবুর অ্যাচিভমেণ্ট ! আমি তো তার সিরজাম গো! এই দেখ না খামার বাড়ি টার নাম দিয়েছি ‘ সিরজাম’? আমি, ওই বাগান, বীজতলা, সবজি খেত, পুকুর, লজ, সব সবই তাঁর হাতের ‘সিরজাম’। নন্দিনীর মনে পড়ল বুধন কাকার কাছে টুটুল জিজ্ঞাসা করেছিল নামের মানে। সিরজাম অর্থ সিরজন. ….সৃজন.. ….সৃষ্টি। চোখের কোণ টা ভিজে উঠল নন্দিনীরও।

15 thoughts on “ছোটগল্পঃ অ্যাচিভমেন্ট – অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত (কলকাতা)

    1. অসাধারণ একটি গল্প ,এক নিঃশ্বাসে মুগ্ধ হয়ে পড়লাম l

  1. বেশ। মনে হল সামনে বসেই শুনছি।ষষ্ঠী র সকাল ভালো কাটল।লেখক এর লেখায় আছে এক মধুর সুর।আরও লেখা পড়তে

    1. কী বলবো ? অনবদ্য বললেও কিছু কম হয়ে যাবে যে l সত্যি বলছি ভাষাহীন l শুধু এইটুকুই বলার ,আরো এরকম “সিরজাম”
      পাবার প্রতীক্ষায় রইলাম l

  2. লেখা পড়ে খুবই ভাল লাগল । গল্প বলে মনেই হয়না । মনে হয় সত্যি ঘটনা । ছবির মত । তবে লেখিকাকে আমি চিনি বলে হয়ত মনে হচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ছোঁয়া ও আছে । আগে বলেছি আবারও বলছি লেখিকার লেখার হাত সত্যি খুব ভাল । জীবন ও মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারনা আছে । আমি আশা রাখি ওনার কাছ থেকে আর ও লেখা পাব।

  3. কী বলবো ? অনবদ্য বললেও কিছু কম হয়ে যাবে যে l সত্যি বলছি ভাষাহীন l শুধু এইটুকুই বলার ,আরো এরকম “সিরজাম”
    পাবার প্রতীক্ষায় রইলাম l

  4. অনবদ্য রচনা, খুব সাবলীল এবং বলিষ্ঠ লেখনী। লেখিকার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা ।

  5. সবাই কে অনেক ভালবাসা আর শুভেচ্ছা। আমাকে উতসাহ দিয়ে সাহস বাড়িয়েছ। এবার পরে, পড়ে সহ্য করতে হবে সে কথাও নিয়ে নিলাম সবার থেকে। সবাই ভাল থেকো, সাবধানে থেকো।

    অলকানন্দা

    1. Chitra banerjeer devakoronir Diasphoric writting gulor songe e lekha tulonio.Lekhika tar prothom lekhatei Diasphoric flower er chap rekhechen.Bangla vasay prothom lekhikar emon onoboddo rochona asa kori agami dine pathokkul tar chotogolper protikkhay opekkharoto thakben.

Leave a Reply to অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *