ছোটগল্পঃ প্রাণের খেলা – অদিতি ঘোষদস্তিদার (নিউ জার্সি, ইউ এস এ)

প্রাণের খেলা
অদিতি ঘোষদস্তিদার

শোভা, গেলে কোথায়, দেখো কাকে ধরে এনেছি! শোভা, ও শোভা,…”
অনিলবাবুর গমগমে আওয়াজ দোতলা অবধি পৌঁছলো। তাড়াহুড়ো করে কাজ শোভা আর আগের মতো”শোভা,  করতে পারেন না, বার বার এই ওপর নিচ করাই কি কম কষ্টের! কিন্তু কিছু জিনিস তো নিজে না করলে হয়ও না। মায়ের নথ পরান হয়নি কলাবউ স্নানের পর, সেটার খেয়াল পড়লো সপ্তমীর অঞ্জলি দেবার সময়! ঠাকুরমশাই তাড়া দিচ্ছেন আরতির জন্যে! এই সময় কিনা কর্তার হাঁকডাক! কাকে না কাকে জুটিয়ে এনেছেন আবার!
ঝামটা মেরে একটা উত্তর দিতে যাবেন, কানে এলো,
“তুইও যেমন! সেই কবেকার কথা, এদ্দিন পর বৌঠানের মনে আছে নাকি?”
কার গলা আজ এই শরতের দুপুরে কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশিল? কে এসেছেন? তবে কি? শোভার পা দু’খানা এমন অবশ হয়ে যাচ্ছে কেন?
চারপাশ থেকে হু হু করে সরে যাচ্ছে স্থান কাল পাত্র! স্মৃতির নৌকা বেয়ে কালের নদীতে ভেসে চললেন শোভা।
নৌকা গিয়ে ঠেকলো কোয়ার্টারের দিনগুলোয়। চাকরি সূত্রে তখন অনিল শিলিগুড়িতে। বড় ছেলে বছর সাতেক। কোলেরটা চার।
হঠাৎই একদিন অনিল ধরে আনলেন অনির্বাণকে। ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু। কলেজের প্রফেসর। উস্কোখুস্কো চুল, মোটা ফ্রেমের চশমার মানুষটাকে দেখেই কেমন যেন মায়ায় মন ভরে গেছিলো শোভার।
নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন শোভা, এই কি ভালোবাসা?
যখনি অনির্বাণ আসতেন, শোভার সারা অস্তিত্ব জুড়ে কিসের যেন এক হিল্লোল!
দু’ছেলের মা, দশ বছরের পাকা গিন্নি শোভা তখন যেন এক ষোড়শী, বুকে নতুন প্রেমের অঙ্কুর!
সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে স্কুলের গন্ডি পার হবার পরপরই, স্বামী তো ভালোই, আর পাঁচটা মানুষ যেমন হয়, দোষে গুণে- স্ত্রীর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
তবুও কেন অনির্বাণের গলা কানে এলেই বুকে ঢেঁকির পাড়!  
অনেক শাসন করেছেন নিজেকে শোভা। এমন হয়েছে যে অনির্বাণ এসেছেন, সামনে যাবেন না বলে মাথা ধরার অছিলায় শুয়ে থেকেছেন, অনির্বাণ এসে অনিলের সঙ্গে গল্প করে, বাচ্চাদের আদর করে চলে গেছেন, তারপর শোভা কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছেন গোপনে।
অনির্বাণ বিয়ে থা করেননি। মেতে থাকতেন ছাত্রছাত্রী আর সমাজ সেবায়। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল সেই বোহেমিয়ানায়। চিরকালের হিসেবি অনিলের মনেও তাই হয়তো অনির্বাণের জন্যে একটা আলাদা জায়গা ছিল।
মাঝে মাঝেই নানা কাজে উধাও হয়ে যেতেন এখানে ওখানে অনির্বাণ।  অনিল খোঁজ নিয়ে মেসে গিয়ে আবার ডেকে নিয়ে আসতেন।
বছর চারেক শিলিগুড়িতে থাকার পর হঠাৎ মধ্যপ্রদেশের এক অনামী জায়গায় বদলি হয়ে গেলেন অনিল। শোভা গেলেন না। ছেলেপুলে নিয়ে কলকাতার সাবেকি বাড়িতে রয়ে গেলেন। দোল দুর্গোৎসব পালা পার্বণ মিলে সারাবছরই জাঁকজমক। শাশুড়ি, খুড়শাশুড়ির পর এখন সবকিছুরই দায় দায়িত্ব শোভার। 

কলকাতায় আসার পর অনির্বাণের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি -আচমকা ঝড়ের মত জীবনে এসে আবার সেভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলেন অনির্বাণ। শিলিগুড়ি ছাড়ার আগে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন অনিল – যোগাযোগ রাখার। কিন্তু কালের প্রবাহে সব কথাই গেছে ভেসে।

আগে আগে মনে হত হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যায় যদি কোনদিন আচমকা। মেলায়, ভিড়ে চারপাশে কারণ ছাড়াই চোখদুটো খুঁজতো যেন কাকে। কানদুটো অপেক্ষা করত কোন চেনা  ডাকের জন্যে। 

সে আজ প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা।

 সেদিনের সেই যুবতী আজ পাকাপাকি গিন্নি। সংসারের পাকে পাকে জড়ান। 

তবুও কোন মেঘলা দুপুরে বা হেমন্তের কোন বিষণ্ণ সন্ধ্যায় কে জানে কার তরে শোভার মন কেমন করে।
“শোভা! শোভা, দেখো না ছোট বৌমা তোমার মা কোথায় গেলেন!”
অনিলের অধৈর্য গলা।
দুরুদুরু বুক নিয়ে ওপরের বারান্দা থেকে মুখ ঝোঁকালেন শোভা। বুকে দিমি দিমি মাদল।
“কি হয়েছে!” গলা দিয়ে যেন স্বরই বেরোতে চাইছে না।
“চিনতে পারছেন বৌঠান?”
আবার সেই গলা। ৩০ বছরে চুল পেকেছে, একটু রোগাও হয়েছেন।  তবু সেই উস্কোখুস্কো চেহারা আর গালভরা হাসি।
সপ্তমীর আরতির পর প্রসাদ বিতরণ। তারপর ভোগ। আজ ঘরোয়া।  কাল ঠাকুর আসবে। অনেক লোকের পাত পড়বে।
কোন কিছুতেই যেন পুরো মনটা নেই আজ শোভার। বার বার ভুল হয়ে যাচ্ছে কাজে!
কালকের বাজারের দায়িত্বটা ছোট জা আর দেওরকে দিয়ে এসে দাঁড়ালেন দুই বন্ধুর সামনে। হাতে চায়ের কাপ।  
“আপনার এখনো মনে আছে আমার চিনি ছাড়া চা!” উচ্ছ্বসিত অনির্বাণ।
“এই বয়েসে সবারই ওই বুঝলি! তাই আলাদা আর কিছু নয়!” অনিলের ব্যাখ্যা।
“তুমি তো আড়ালে এখনো দু’চামচ চিনি ঢাল, আমি বুঝি টের পাই না?”
হাসিতে খুনসুটিতে আবার সেই তিরিশ বছর আগের দিন।
“জানো, অনির মাথা থেকে এখনো সেই সমাজসেবার ভূত নামেনি। তাই অবশ্য ওকে পেলাম এতদিন পর। কাজেই এসেছিল এইদিকে। দেখতে পেয়েই পাকড়াও। ভাগ্যিস চেহারা বদলায়নি তোর!”

 “কি ধরণের কাজ?” কৌতূহলী শোভা। 

“সমাজে লাঞ্ছিত মেয়েদের জন্যে একটা প্রতিষ্ঠান আছে ওদের। মেয়েরা সেখানে যাতে স্বাধীন আর স্বনির্ভর ভাবে বাঁচতে পারে, তার জন্যে একটা ছোটখাট বাড়ি বানাবার প্ল্যান।” 

“অনেক খরচ বৌঠান! অনেক পয়সার দরকার! মেয়েগুলো যদি সমাজের চোখরাঙানি থেকে দূরে সরে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারে! আপনারা যদি এগিয়ে আসেন, আমি হাত পাতছি বৌঠান!”

ওই হাতে নিজের কোনকিছুই কি অদেয় আছে শোভার? বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।

“ও আবার কি দেবে? আমি দেব যতটা পারি। এগিয়ে যা। দাতা হিসেবে আমার নামটা কিন্তু উল্লেখ করতে ভুলে যাস না আবার? বাড়িতে ঢুকতেই একটা ফলক- টলক.., ” হা হা করে হাসলেন অনিল। 

চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছিলো। শোভা কাপগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

একটু পরেই ফিরে এলেন। হাতে একটি ছোট পুরোনো ভেলভেটের বাক্স। 

“আমার তো শুধু নিজের বলতে কিছুই নেই, সবই ওনার দেওয়া। শুধু এই হারটা ঠাকুমা দিয়েছিলেন মহকুমার মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম বলে। তারপরই তো বিয়ে হয়ে গেলো। একটি মেয়েরও যদি কাজে লাগে! আপনি ফেরাবেন না যেন!”

অনিল হতবাক। এতো বছরে কখনো তো শোভা বলেনি এই হারের গল্প! 

অনির্বাণ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “ফেরাব এমন সাধ্য কী বৌঠান! আমার ভিখারি শিব হবার যোগ্যতা না থাকলেও আপনি তো অন্নপূর্ণা!”

4 thoughts on “ছোটগল্পঃ প্রাণের খেলা – অদিতি ঘোষদস্তিদার (নিউ জার্সি, ইউ এস এ)

  1. ভালোবাসার কি অপ্রতিরোধ্য গতি। ছত্রে ছত্রে জানিয়ে গেল, অপূর্ব।

  2. পবিত্র প্রেমের গল্প। বেশ ভাল।

  3. সুন্দর একটা মিষ্টি মিষ্টি গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *