ছোটগল্পঃ গ্রাস – শংখ ভট্টাচার্য (কলকাতা)

গ্রাস

শংখ ভট্টাচার্য

— ‘না না, জমিটা আমি ছাড়তে পারব না।’ বেশ ঝাঁঝাঁলো সুরেই কথাগুলো বলে সজল।

মাত্র তো তিনকাঠা জমি। দেড় কাঠার ওপর পৈত্রিক দোতলা বাড়ি। বাকি দেড় কাঠায় সজলের সখের বাগান। সামনে ফুলের বাগান আর পিছনে সব্জির। কেউ ফুল ছিঁড়লে তুলকালাম করে সজল। কিন্তু সব্জির ক্ষেত্রে ও উদার। প্রতিবেশীরা শিম, টমেটো, লংকা, পুঁইশাক, নিয়ে যায়। লাউ, কুমড়ো হলে প্রতিবেশীদের পাঠায় সজলের বউ কেয়া। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখেই চলে সজল। ওর বাবা সুবল রায় পাড়ার পুজো থেকে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জরিয়ে ছিল। সজল চিরদিনই সে সবের থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে।
— সজলদা, একবার ভেবে দেখতে পারতে। তুমি তো ফ্ল্যাট পাবেই, তাছাড়া কিছু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সও হয়ে যাবে। তোমার তো একটাই ছেলে। প্রস্তাবটা খারাপ দিচ্ছি না। তাছাড়া তোমার ডান পাশের দাস ও বাঁ পাশের বোসরাও দিচ্ছে তো। তাই তোমারটা পেলে এক লপ্তে বড়ো করে ফ্ল্যাটটা করা যায়।
— তুমি বুঝতে পারছ না কমল, মাথা গোঁজার ঠাঁই তো হবে কিন্তু বাগান তো হবে না।
— তা হবে না ঠিকই, কিন্তু তোমার লোকসান হবে না। ঠিক আছে, একটু ভেবে দেখ।

ঘরের দেওয়ালে টিকটিকিটা অনেকক্ষণ ধরে ওৎ পেতে বসে আছে। আরশোলাটা উড়ে এসে বসেছে একটু দূরে। ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পনে এক পা, এক পা করে এগোচ্ছে টিকটিকিটা আরশোলাটার দিকে।
— কী হল কমলদা, সজলটা তো বড়ো ন্যাকড়াবাজি শুরু করেছে। দু দিন টরচার করলে বাপ বাপ বলে পালাবে। দেবো নাকি ছেলেদের লেলিয়ে?
— না শ্যামা, একদম নয়।
— এতবড়ো প্রজেক্টটা কী ছেড়ে দেবে নাকি দাদা?
— নানা, সে প্রশ্নই নেই। অপেক্ষা কর … সবুরে ….
* * *
— হ্যালো, সজল রায় বলছেন? মুচিপাড়া থানা থেকে বলছি। আপনার ছেলে অলোক আর.জি.কর হাসপাতালে ভর্তি আছে। একটা দুর্ঘটনায় আহত। আপনি এখনই চলে আসুন।
— হ্যাঁ, যাচ্ছি, যাচ্ছি।
সজল হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। গেটের সামনে কমলের সঙ্গে দেখা।
— কোথায় চল্ লে গো সজলদা?
— কমল, আমার ছেলে…কান্নায় গলা বুজে আসে সজলের।
— কী হয়েছে অলোকের?
— অ্যাক্সিডেন্ট! আর.জি.করে ভর্তি। মুচিপাড়া থানা থেকে ফোন করে বলল। যাচ্ছি….
— তুমি বৌদিকে নিয়ে যাও, চলো, আমি আর শ্যামল বাইকে যাচ্ছি।
* * *
— রক্ত দিতে হবে। কী হবে কমল?
— চিন্তা কোরো না। আমরা তো আছি। তুমি বস, আমি দেখছি। শ্যামল, ক্লাবে নান্টুকে ফোন করে বল, রক্তদাতাদের কার্ডগুলো তুলে নিয়ে এখানে চলে আসুক। কুড়ি মিনিটের মধ্যে বাইকে আসতে বলবি।
দুশ্চিন্তায় শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সজল, কেয়া মুখ ঢেকে একনাগারে কেঁদে চলেছে।
* * *
রাত শেষ হতে চলল, অলোককে বেডে নিয়ে গিয়েছে। ডাক্তারবাবু জানালো, বিপদ কেটে গিয়েছে। রক্তের ব্যাবস্থাটা তাড়াতাড়ি হওয়াতেই উদ্ধার পাওয়া গিয়েছে।
দেওয়ালে টিকটিকিটা আরশোলার খুব কাছে চলে এসেছে। শুধু একটা ছোট্টো লাফ ….
— সজলদা বৌদিকে নিয়ে বাড়ি যাও। শ্যামা আর ভোলা তো থাকছে। নিশ্চিন্তে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। বৌদি, আর চোখের জল নয়, নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। কাল এসে দেখবেন অলোক একদম ফিট।
— কমল, রবিবারে কাগজপত্র নিয়ে এস। কোথায় সই করতে হবে করে দেব।
— ও সব হবে খন। তুমি বাড়ি যাও, নিশ্চিন্তে ঘুমাও।
— চল্ রে শ্যামল,
— তুমি জিনিয়াস দাদা…
টিকটিকিটা মুখের মধ্যে ধরে ফেলেছে আরশোলাটাকে। ধরা পড়েও আরশোলাটার ছটপট করারও উপায় নেই।

One thought on “ছোটগল্পঃ গ্রাস – শংখ ভট্টাচার্য (কলকাতা)

  1. বাস্তব চিত্র। ভাল লাগল।
    সেচ্ছায় কেউ দিতে চাইলে একরকম । তা না হলে , প্রোমোটারদের গুন্ডাগিরির তীব্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *