ছোটগল্পঃ সমুদ্র – দেবাশিস রায় ( বর্ধমান)

  সমুদ্র

          দেবাশিস রায়

তিয়াশা ফোন করেছে। আড়চোখে ফোনটার দিকে তাকিয়ে নিলয় একটু অবাক হোল। এত রাতে সচরাচর তিয়াশা ফোন করে না। আজ এইসময়ে? কি ব্যাপার? একটু উদ্বিগ্নতার সাথে কলটা রিসিভ করলো। 

“ কি গো? সব ঠিক আছে তো?” নিলয় খুব স্বাভাবিক প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো। 

“ হ্যাঁ। হ্যাঁ। সব ঠিক আছে। স্যরি। এত রাতে ডিস্টার্ব করলাম। কি করছিলে?” 

“ ওই, যা করি। একটা বই নিয়ে বসেছি। বল।”

“ আচ্ছা, চারজনের সম্বন্ধে একটু জানতে চাই। যা জানো, ঠিকঠিক বোলো।”

“ তারা কারা?”

“ তোমার আমার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড। ফেসবুকের। শাল্মলী সেনগুপ্ত, সোমা চট্টরাজ, স্নিগ্ধা রায় আর শমিতা পাঁজা। এদের সম্বন্ধে যা জানো, একটু বলো।”

নিলয় ভীষণ অবাক হোল। কিন্তু সাথে সাথে এটাও বূঝলো, নিশ্চয়ই কোন গূঢ় কারণ লুকিয়ে রয়েছে এর পেছনে। সেটা কি, জানা দরকার। নিজের বিস্ময়টা লুকিয়ে রেখে খুব শান্তভাবে উত্তর দিল, “ দ্যাখো, বাস্তবিক অর্থে এঁদের আমি চিনি না। কোনদিন সামনা সামনি মোলাকাত হয় নি। ফোনেও কারো সাথে কথা হয় নি। প্রথম দুজনের সাথে ইনবক্সে সামান্য কিছু টুকটাক কথাবার্তা হয়েছে। তাও বহুদিন আগে। তুমি জানো, আমার ওই অহেতুক ইনবক্সে গল্প করা পছন্দ নয়। ওরা ফ্রেন্ড লিস্টে আছে, আছে। পড়ে আছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তো আমি জানি না এঁদের ব্যাপারে।”

“ আচ্ছা, মানুষ হিসেবে এঁদের কেমন মনে হয়? এনি রাফ আইডিয়া?”

“ প্রথম জন, শাল্মলী, বহুদিন আছেন আমার ফ্রেন্ড লিস্টে। গৌহাটিতে থাকেন। একবার অন্য আরেকজনের পোষ্টে দেখেছিলাম, গৌহাটিতে তিনি বিপদে পড়ায় এই শাল্মলী ওনাকে খুঁজে বের করে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। তাতে আমার মনে একটা ধারনা তৈরি হয়েছে উনি পরোপকারী। বাকিদের ব্যাপারে আমার তেমন কোন আইডিয়া নেই।”

“ তোমার কি মনে হয়েছে কখনও, স্নিগ্ধা রায় কেবল নিজের পরিচিতজনদের সাথে শুধু মিশতে ভালোবাসেন। খুব অহংকারী।”

“ আমার পোষ্টে কখনও কখনও লাইক কমেণ্টস করেন দেখেছি। এর বেশি তো কিছু জানি না ওনার সম্বন্ধে। কি ব্যাপার বল, তো?” 

“ বলছি। এক মিনিট। আর দু একটা জিনিস জানতে চাইছি। তারপরে সব বলছি। তুমি স্নিগ্ধা বা সোমার লেখা পড়েছ?”

“ না। পড়ি নি।“

“ সে কি! সোমাকে নিয়ে তো ফেসবুকে খুব হইচই। দারুণ লিখছে না কি মেয়েটা।”

“ তাই? তাহলে দাঁড়াও। একটু দেখে নিয়ে বলছি।“ নিলয় চট করে ফেসবুকে গেল। সোমা চট্টরাজের প্রোফাইল খুঁজে পেতে অসুবিধা হোল না। একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ওয়ালের লেখাগুলোতে।“ হ্যালো। দেখলাম। মেয়েটার লেখবার হাত আছে। কনসেপ্ট গুলো ভালো তুলে আনে। কিন্তু লেখার ভাষা বড্ড একঘেয়ে। দুটো কবিতা পড়বার পরে তৃতীয়টা আর ভালো লাগবে না।”

“ তাহলে এঁদের সম্বন্ধে এই তোমার মোটামুটি আইডিয়া, তাই তো?”

“ হুম। তা বলতে পারো। কিন্তু এত রাতে তুমি এসব জানতে চাইছ কেন? সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার।”

“ বলছি। আচ্ছা, অচেনা মানুষদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা তৈরি হয় কিভাবে, বলতে পারো?” 

“ নানা ভাবে। আমি যেমন কারো পছন্দ অপছন্দ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। তাতে একটা রাফ আইডিয়া পেয়ে যাই।”

“ কিন্তু তার জন্য তো সেই মানুষটার সাথে পরিচিত হতে হয়। অন্তত কথাবার্তা তো একটু হলেও বলতে হয়। না হলে তার পছন্দ অপছন্দ বূঝবে কি করে? আমি জানতে চাইছি, কেউ ধর একদম অপরিচিত। তার সম্বন্ধে ধারণা কিভাবে তৈরি করবো?” 

একটু ভেবে নিয়ে নিলয় বলল,“ যেভাবে সমুদ্রের পারে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে দেখি। ধারণা তৈরি করি।”

“ কেমন সেটা?”

“ দেখি সমুদ্র উত্তাল। অশান্ত। ক্রমাগত ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ভয় পাই জলে পা দিতে।”

“ ঠিক। সেই জন্যই কি আমরা অপরিচিত মানুষদের সাথে পরিচিত হতে ভয় পাই?”

“ বলতে পারো। কেউ হয়তো বলল, কিছু হবে না। জলে পা দিন। দিলাম। কিন্তু দেখলাম জলের চোরা টান আছে। সে যখন সরে যাচ্ছে, পায়ের তলার বালিও সাথে সাথে সরে যাচ্ছে। জলে পা না দিয়ে যত শক্ত ভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, তত শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছি।”

“ আমরা কি তাই নতুন সম্পর্কে ভয় পাই?”

“ এই, কি ব্যাপার বল তো? কোন নতুন প্রেমিক জুটেছে না কি তোমার?” 

“ হুম। জুটেছে।”

“ তাই না কি? নাম কি?”

“ নাম? নাম নিলয় চক্রবর্তী।”

“ ধুত। এত রাতে ইয়ার্কি মেরো না তো।”

“ ইয়ার্কি নয় সোনা। আমি আজকাল মাঝে মাঝেই নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ছি। কেন জানো? মাঝে মাঝে তোমাকে খুব অপরিচিত বলে মনে হয়। সেটা যখন কেটে যায়, আমি আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি। এটা কেন হচ্ছে বলতে পারো? আমার সম্বন্ধে তোমারও কি এমন মনে হয়? মনে হয়, আমরা অপরিচিত?”

“ দ্যাখো। একটা সময় তো ছিল যখন আমরা একে অন্যের অপরিচিত ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে সেই প্রাচীর টপকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। সম্পর্ক একটা সমুদ্রের মত। প্রথম প্রথম তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা তার অশান্ত, অনিশ্চিত রূপ দেখে ভয় পাই। সম্পর্কের জলে পা ভেজাতে ইতস্তত করি। আস্তে আস্তে সাহস বাড়ে। এক পা, দু পা করে জলের মধ্যে এগোই। ঢেউ আসে। পার হই। বেশ কয়েকটা ঢেঊ পেরিয়ে এসে দেখি সমুদ্র শান্ত, সমাহিত।”

“ আচ্ছা। তাহলে যে চার জনের নাম বললাম, ওদের তুমি কিভাবে দেখছ?”

এবারে নিলয় বিরক্ত হোল। “ উফ। আবার ঘুরে ফিরে তুমি সেই পুরনো জায়গায় ফিরে এলে?”

“ আহা। রাগছ কেন? বলোই না।“ তিয়াশা একটু অভিমানের সুরে বলল। 

“ ধর, ওদের ব্যাপারে আমি সমুদ্রের পারে দাঁড়িয়ে রয়েছি।”

“ বেশ। আর আমি কোথায়?”

“ তুমি আমার সাথে সমুদ্রের মাঝখানে। সমস্ত ঢেউ আমরা পেরিয়ে এসেছি। এখন শান্ত জলে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। তোমার সাথে ওদের তুলনা করছ কেন?”

“ করছি, তার কারণ আছে। তুমি তো জানো আমি একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি।”

“ হুম জানি তো। সেই জন্যই এত রাতে তোমার ফোন পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলাম।”

“ জানো। আজ ঘুমিয়ে পড়েই একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে উঠে বসি। স্বপ্নে দেখি, তুমি একটি অচেনা মেয়ের সাথে প্রেম করছ। মেয়েটা অচেনা হলেও মনে হোল কোন ভাবে চিনি তাকে। স্বপ্নের মধ্যেই ফেসবুক খুলে দেখি সেই মেয়েটি তোমার আর আমার কমন ফ্রেন্ড। যদিও মেয়েটিকে আমি চিনতে পারছিলাম না। ঠিক এই সময়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাঙ্গবার পরে অনেক চেষ্টা করেও আমি সেই মেয়েটিকে আর নির্দিষ্ট করতে পারলাম না। মনে করতে পারলাম না। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তাই, আর থাকতে না পেরে তোমাকে ফোন করে বসলাম। রাগ করলে আমার পাগলামিতে?”

নিলয় ভেবে পেল না এই ক্ষেত্রে ওর বলবার কি আছে। ভূমিকাই বা কি আছে? ও তো এই নাটকের একটি চরিত্র মাত্র। যে নাটকের নির্মাণ হয়েছে একটি ভার্চুয়াল দুনিয়ার আরেকটি ভার্চুয়াল দুনিয়াতে প্রবেশের মধ্যে দিয়ে। আজ এই ভার্চুয়াল দুনিয়া প্রতিনিয়ত ভয় দেখায়। ঢেউ সৃষ্টি করে। আছড়ে পড়বার চেষ্টা করে বাস্তবের বালুকাময় প্রান্তরে। কত পা ঢেউ পেরোবার আগেই পায়ের তলার বালি সরে গিয়ে টলমল করতে করতে পড়ে যায়। অবিশ্বাসের জলস্রোত উল্টে পাল্টে বেসামাল করে দেয়। দুজনকে ঠেলে দেয় দুই প্রান্তে, বিচ্ছিন্ন করে দেয়। 

 তিয়াশা একটু ধমকের সুরে এবার বলে, “ এই। এত আকাশ কুসুম কি ভাবছ তুমি? একদম চুপ করে গেলে যে? শোনো, অত ভেবে আর কাজ নেই। আমরা যখন ঢেউ পেরিয়ে সমুদ্রের শান্ত জলে পৌঁছে গিয়েছি, তখন তোমার আর অশান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। অনেক রাত হয়েছে। এক গ্লাশ জল খেয়ে বই রেখে লক্ষ্মী ছেলের মত চুপটি করে ঘুমিয়ে পড় দেখি এবার। শুভ রাত্রি।”

নিলয় বই বন্ধ করল। কিন্তু ঘুম আর এখন আসবে কি? কে জানে।। 

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ সমুদ্র – দেবাশিস রায় ( বর্ধমান)

Leave a Reply to Krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *