ছোটগল্পঃ সহাবস্থান – পার্থ রায় (কলকাতা)

সহাবস্থান

পার্থ রায়

রাজধানী এক্সপ্রেসের এই এসি কুপটা যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, শীতল এক দ্বীপ। করপোরেট একজিকিউটিভ শান্তনু তার ল্যাপটপে। ওর বউ রঞ্জনা ফেসবুকে ডুবে আছে। রঞ্জনার ফর্সা মুখে লাজে রাঙ্গা নুতন প্রেমিকার রঙ। শান্তনুর কপালে মৃদু ভাঁজ। ওদের একমাত্র মেয়ে সাত বছরের শিঞ্জিনী ঝাপসা জানালা দিয়ে কিছুক্ষন উঁকি মেরে হতাশ হয়ে ওর থেকে একটু ছোট সহযাত্রীর সাথে ভাব করার জন্য উসখুস করছে। এসি কামরায় শীতল সুখ আছে কিন্তু বাইরের দৃশ্য দুচোখ ভরে উপভোগ করা যায় না। আর এক দম্পতি ডাঃ সুজয় সান্যাল আর তার স্ত্রী নিরালা যথাক্রমে একটা মেডিক্যাল জার্নালে আর হোয়াটস অ্যাপে ডুবে আছে। নিরালার আঙ্গুল অভ্যস্ত গতিতে সেলফোনের স্ক্রিনে ওঠানামা করছে। ওদের ছয় বছরের ছেলে ঋষিরাজ একটা চকোলেট শেষ করে চিপসের প্যাকেটে হাত বাড়াতেই মায়ের ভ্রুকুটির সামনে পড়ল। বুদ্ধিমান ঋষিরাজ শিঞ্জিনীর দিকে দেখিয়ে বলল, “মাম্মি, ফ্রেন্ডকেও দেব?”। নীরবে সম্মতি দিয়ে নিরালা মুঠোফোনের স্ক্রিনে কাঁচ পোকা হয়ে যায়। কামরায় আর এক যাত্রী প্রবীণা। বয় কাট চুলের প্রায় সবটাই সাদা। কোলে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের একটা উপন্যাস। দুচোখের হাসি ব্যাক্তিত্বের পাশাপাশি একটা স্নেহময়ী শ্রীকে স্থায়ী ঠিকানা দিয়েছে। কামরার অন্য সেলফোন গুলোর তুলনায় ওঁর সেলফোনটা যেন সরকারি কর্মচারীদের মত। বেশি ছুটি ভোগে অভ্যস্ত। এক পাশে ঘুমিয়ে আছে। কনিষ্ঠতম যাত্রী দুজন প্রথমদিকে নিঃসঙ্গ থাকলেও চিপস বিনিময়ের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা বইটা না খুলে বেশ তারিয়ে তারিয়ে ওদের কলকাকলি, হ্যান্ড ক্রিকেট, ছুটোছুটি উপভোগ করছিলেন। বিধি বাম। এই শিশুসুলভ আচরণ তাদের আধুনিক বাবা মায়েদের শান্তির ব্যাঘাত ঘটাল। স্বাভাবিক শৈশবকে স্তব্ধ করার মহান ব্রতে শান্তনু, রঞ্জনা আর নিরালা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো গুটি কয়েক ধমক ছুঁড়ে দিল। সুজয় মুখে কিছু না বললেও বিরক্তি প্রকাশ করে ঐক্যমত্যের জানান দিল।

“মিমি, প্লীজ স্টপ শাউটিং। সিট কোয়ায়েটলি”    

“ঋষি, ঋষি দিস ইজ ভেরি ব্যাড”

“আহ! ঋষি কী হচ্ছেটা কী? এটা তোমার বাড়ী নয়। চুপ করে বসো”

“মিমি, তোমার বাপির অসুবিধা হচ্ছে”

শেষের এই ক্ষেপণাস্ত্র যার উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত হল তাকে কতটা বিদ্ধ করতে পারল বোঝা গেল না। অন্য একজন বিদ্ধ হয়ে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ল। “বাপির অসুবিধা? হাহ! তোমার চ্যাট করতে অসুবিধা হচ্ছে সেটা বলো”। রঞ্জনা স্বামীর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কামরায় এখন এক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। ওদের করুণ মুখ দেখে প্রবীণার মায়া হল। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঋষিকে কোলের কাছে টেনে সস্নেহে বললেন, “আমাকে তোমাদের খেলা শেখাবে? আমিও তাহলে তোমাদের সাথে খেলতে পারি”। কথা বলতে বলতে উনি হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা স্টিলের কৌট বের করলেন। ট্রেনিং প্রাপ্ত সৈনিকের মতো ঋষি তার মায়ের দিকে তাকাতে নিরালা প্রবীণার উদ্দেশে বলল, “দিদি, প্লীজ ডোন্ট ডু দিস। আপনি জানেন না ও কী সাঙ্ঘাতিক দুরন্ত!”। প্রবীণা স্মিত হেসে বললেন, “লিভ ইট টু মি প্লিজ। আই নো হাউ টু হ্যান্ডেল দেম। বিং আ প্রিন্সিপাল অফ আ গার্লস কলেজ আই হ্যাভ বিন হ্যান্ডলিং মাচ গ্রেটার থিঙ্গস ফর দ্য লাস্ট থার্টিথ্রি ইয়ারস। ওরা যা করছে সেটাই সুস্থতা। সেটাই এই বয়েসে স্বাভাবিক। ডু হোয়াট উ আর ডুইং”। চার জোড়া চোখ সসম্ভ্রমে ওঁর দিকে তাকিয়ে যে যার কাজে মুখ লুকিয়ে স্বস্তি পেল। ঋষি আর শিঞ্জিনী পরম সুখে দুধ দিয়ে তৈরি নারকেলের নাড়ুর অনাস্বাদিত স্বাদ উপভোগ করতে করতে প্রবীণার কোলে সেঁধিয়ে গল্পে মেতে ওঠে। রাজধানী এক্সপ্রেস দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে।

3 thoughts on “ছোটগল্পঃ সহাবস্থান – পার্থ রায় (কলকাতা)

    1. অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা, বন্ধু প্রবীর বাবু।

  1. ভীষণ ভালো লেগেছে। একেবারে বাস্তব চিত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *