সঙ্গীতশিল্পী রিজিয়া করিম স্মরণে
দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেল। কোনদিন ভাবিনি বৌদিকে নিয়ে কিছু লিখতে হবে। কোনদিন ভাবিনি আমার তোলা এই ছবির সঙ্গে লিখতে হবে তাঁর স্মৃতিকথা। কত স্মৃতি, সব ভিড় করে আসে অলস মনে।
একটু আগে থেকেই শুরু করা যাক। কলেজ স্ট্রীটে বাংলার মুখ পত্রিকার সাপ্তাহিক এক আড্ডায় আলাপ হয়েছিল আনিসুলদার সঙ্গে।বাড়ি তাঁর হাওড়াতেই, আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। তারপর যখন চোদ্দশ বঙ্গাব্দে “বঙ্গাব্দের চতুর্দশ পূর্তি উৎসব সমিতি” গঠন করা চলছে, আমি আনিসুলদাকে হাওড়া জেলার কমিটিতে যুক্ত করার জন্য তাঁর সরকারী আবাসনে তাঁকে খুঁজতে গেলাম। সেদিন ফ্ল্যাটের নম্বর না জানার জন্য আনিসুলদার খোঁজ পেলামনা যদিও, কিন্তু কয়েক মাস পর তাঁর সঙ্গে বাসে দেখা হয়ে গেল। ফ্ল্যাট নম্বর নিয়ে কিছুদিন পর হাজির হলাম তাঁর ফ্ল্যাটে। সেদিন তাঁর সঙ্গেতো আলাপ হলই, সঙ্গে আলাপ হল তাঁর স্ত্রী রিজিয়া বৌদির সঙ্গে ও ছেলে শাওনের সঙ্গে। বৌদি যে একজন গুণী মানুষ, তা সেদিনই বুঝলাম এবং তাঁর ছেলেও অত্যন্ত মেধাবি, খেলাধূলাতেও খুব ভালো সেটাও জানলাম। জানলাম আনিসুলদার বাড়ি বসিরহাটে, কিন্তু কর্মসূত্রে এই সরকারী আবাসনে থাকা। তবে তাঁরা হাওড়া শহরকে ভালোবেসে একাত্ম হয়েছিলেন প্রথম থেকেই।
বৌদি হাওড়াতে এসে যুক্ত হয়েছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের স্হানীয় শাখার সঙ্গে। বৌদি যখন স্কুলের ছাত্রী,তখন থেকেই স্কুলের যে কোন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিতেন সক্রিয় ভূমিকা। স্কুলে সংগীতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে করতে ভালোবেসে ফেলেছিলেন সংগীতকে।গান শেখার প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে তাঁর গান শেখা হয়নি। তবে তিনি একটি হারমোনিয়াম সংগ্রহ করেছিলেন, যেটি ছিল তাঁর প্রাণ। মুর্শিদাবাদের মেয়ে রিজিয়া বিয়ের পর বসিরহাট হয়ে এলেন হাওড়াতে; তারপর স্হানীয় সংগীত কলা বিকাশ কেন্দ্রে ভর্তি হলেন সংগীত শিক্ষার জন্য।আনিসুলদার উৎসাহে আর নিজের অধ্যবসায়ে স্রোতস্বিনী নদীর মতো এগিয়ে চললেন।বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদের আটটি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে সম্মান অর্জন করলেন তিনি। যে সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্রের তিনি একদিন ছাত্রী ছিলেন,সেই শিক্ষা কেন্দ্রে তিনি শিক্ষিকার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।তাঁর একমাত্র পুত্র শাওন ইনজিনিয়ারিং পাস করে যখন চাকরি পেয়ে অন্য রাজ্যে চলে গেল, আনিসুলদা ব্যস্ত অফিসে; তখন বৌদি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন সংগীত বিভাগে। এম মিউজে প্রথম বিভাগে পাস করলেন। কীর্তনে সর্বোচ্চ নম্বর পেলেন। তারপর বেশ কয়েকটি কর্মশালায় তালিম নিয়েছিলেন পুরাতনী ও টপ্পার। পুরাতনী থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুলগীতি থেকে লোকসঙ্গীত যে কোন ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর অনায়াস দক্ষতা। রবীন্দ্রসদনে কবিপক্ষে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। আকাশবাণীতেও তিনি নিয়মিত শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করার সুযোগ পেয়েছেন।একটি কলেজেও তিনি সঙ্গীত শিক্ষিকার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকত তাঁর উজ্জ্বল উপস্হিতি।সব বয়সের মানুষকেই আপন করে নেবার তাঁর ছিল এক সহজাত ক্ষমতা। সরকারী আবাসনের বিজয়া সম্মিলনী ও রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যায় তিনি কিশোর কিশোরীদের নিয়ে শ্রোতাদের উপহার দিতেন একেকটি সুন্দর অনুষ্ঠান। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি স্বাধিকার মঞ্চের সব অনুষ্ঠানে তিনি ও আনিসুলদা উপস্হিত হতেন সবার আগে। দু হাজার সতেরো সালে ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় শিবপুর শিশুতীর্থ বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছিল এক অনুষ্ঠানের। আনিসুলদা ও বৌদির আসতে একটু দেরি হল; পরে জানলাম বৌদিকে ক্যানসারের ডাক্তারকে দেখিয়ে আসার জন্য এই দেরি। বৌদি ক্যানসারে আক্রান্ত একথা আগেই জেনেছিলাম, কিন্তু অনেকেই তো সুস্হ হয়ে উঠেছেন, তাই বিশ্বাস ছিল বৌদিও সুস্হ হয়ে উঠবেন। সেদিন সন্ধ্যায় বৌদি খুব স্বাভাবিক ভাবেই সঙ্গীত পরিবেশন করলেন। এখন ভাবলে বিস্ময় লাগে যে একজন মানুষের মনের জোর ও সংগীতের প্রতি ভালোবাসা কি পরিমাণ থাকলে তবে এইভাবে অনুষ্ঠান করা যায়। আমার সঙ্গে বৌদির শেষ দেখা আঠেরো মে দু হাজার সতেরো সন্ধ্যাবেলায়।তিনি তাঁর ঘরে শুয়ে, আমাকে দেখে হাসলেন,সামান্য দু একটা কথা হল।মনটা খারাপ হয়ে গেল; বৌদিকেতো কোনদিন শুয়ে থাকতে দেখিনি।হয় গৃহকর্মে না হয় লাইব্রেরী থেকে আনা বইপড়ায় ব্যস্ত, না হয় সংগীত চর্চায়। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এই শূণ্যতা যেমন তাঁর পরিবারে, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, তেমনি আমাদের সমাজে।ছয় অক্টোবর তাঁর প্রয়াণ দিবস।

কত গুণী মানুষ বাংলায় আছেন। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
একজন পজানা গুণী মানুষ সম্পর্কে জানলাম। আমার শ্রদ্ধা জানাই।