গল্পঃ মধুপর্ণা রায়

লকডাউন ও লালমণি
মধুপর্ণা রায়  

জনতা কারফিউ এর ঠিক দিন তিনেক আগের কথা। কি জানি কি কারণে, প্রাণ টা হঠাৎ ‘বসন্ত এসে গেছে’ ভেবে লাফিয়ে উঠলো। দিন দুপুরে ‘লাল পলাশের দেশ’ কে ঘিরে স্বপ্নে বিভোর হলাম। পুরুলিয়ার রাঙা পথ হাত ছানি দিল।         
আমার বরাবরই ওই এক রোগ। উঠল বাই তো কটক যাই। পরের দিনের মধ্যেই সব কিছু ঠিক করে ফেললাম। বাড়িতে বুড়ো – বুড়ি, কচি – কাচা, বাক্স – প্যাটরা … প্রিয় যা কিছু হাতের কাছে পেলাম, সব তৈরি রাখলাম। পরের দিন ভোরে, গাড়ির পেছনে বাক্স বোঝাই করে নিজেরা সামনের দিকের সিট গুলো দখল করলাম।       শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের মিহিদানা – সীতাভোগ, অন্ডালর জিলিপি – কোনো আকর্ষণ ই সেদিন আর আকর্ষণ নয়। অর্জুন তখন লক্ষ্য ভেদ করার অপেক্ষায় অবিচল, গাড়ি সোজা গিয়ে থামলো গড়পঞ্চকোট।
           পাঞ্চেত পাহাড়ের পায়ের কাছে বসে, রাধা – মাধবের মন্দিরের গা ঘেঁসে বানানো ছোট্ট চা এর দোকানের মাটির কাপে তে চা এ চুমুক দিয়ে মানস – চক্ষে সবে বর্গী দের আক্রমণ এর সাক্ষী হতে যাচ্ছি, এমন সময় তেড়ে এলো লালমণি!  সাধ করে আমার নয় বছরের কন্যা টি একটি আগুন রঙের পলাশ মালা গলায় পড়ে বসেছিল, একটি প্রশস্ত নারকোল দড়ির খাটিয়ার ওপর। বোধ করি, লালমণির সে সুখ সহ্য হয় নি। অতর্কিত হামলায় নাতনি টির গায়ে যাতে আঁচড় টিও না পড়ে, তার দাদু – দিদার সে দিকে লক্ষ্য ছিল। অবশ্য, বড়ো কিছু ঘটে যাবার আগেই, দুলালী দিদা মালা গাঁথা ছেড়ে লালমণি কে কোল পাঁজা করে পাশের খুঁটি তে বেঁধে দিল। মুখে বললো, “ই – বাব্বা! ভয় পেইচো ক্যানে গো? উয়ার খিদা লেগিচে … ইয়ার লগেই ওমন টি কইরলেক … ।” “খিদে তো আমারও পেয়েছে, তাই বলে আমি কি অমন দুষ্টুমি করছি, বলো তো?” , মেয়ের অকাট্য যুক্তি। “ই বাব্বা, তো বলো নাই ক্যানে তুমি? আমাদের ঘর দিকে যাব্বে ?” । মেয়ে তার নতুন ফুলওয়ালি দিদার সাথে গল্পে মেতে উঠেছে দেখে আমি ছৌ – মুখোশের ভিড়ে ভিড় জমালাম। পাশেই দেখি, কিছু কচিকাচার দল, বনের তাল পাতা জোগাড় করে, সে গুলো কে দুমড়ে মুচড়ে ফুলের আকার দিয়েছে। মনের আনন্দে ছৌ – মুখোশ, পাতা দিয়ে গড়া ফুলের থোকা — সব কিনে ফেললাম। দৈনিক সংবাদ পত্র দিয়ে যত্ন করে তা মুড়িয়ে দিল গুমটি সামলানো ব্যস্ত বৌদি টি।
             আড্ডা স্থলে গিয়ে দেখি ততক্ষনে সবাই হেসে কুটিপাটি। লাল মণি বেশ বুঝতে পেরেছে যে তাকে ঘিরে শহরের কিছু আগন্তুক আনন্দে আত্মহারা। সে, সেই ফাঁকে যাবতীয় কসরত দেখিয়ে আসর জমিয়ে রেখেছে। এত কিছুর মাঝেই, নতুন ফুল দিদা আমার পরিবার কে, বিকেলে তার ছোট্ট মাটির ঘরে আসার আমন্ত্রণ টি সেরে রেখেছে। চপ – মুড়ি সহযোগে গরম চা এর নিমন্ত্রণ। আমি আমার veto power প্রয়োগ করার সুযোগ আর পেলাম না। তার আগেই দেখি, নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য সকলেই রাজি।               
মুখোশ, পাতায় বোনা ফুলের তোড়া এবং একটি চা এর নিমন্ত্রণ বগলে করে হোটেলে ফিরলাম আমরা। ঠাণ্ডা জলে স্নান সেরে গরম ভাত, শুক্ত, লেবু পাতা দিয়ে সোনা মুসুর ডাল, বেগুন ভাজা, টমেটো – ধনেপাতা – বরি দিয়ে লাউ এর তরকারি, রুই মাছে আলু দিয়ে ঝোল এবং শেষ পাতে আমের চাটনি খেয়ে ছোট্ট একটা ঘুম দিলাম সকলে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই আমরা সকলে মিলে সেই রাধা – মাধবের মন্দিরের গা ঘেঁসে বানানো চায়ের দোকানে হাজির হলাম।  “মা আমায় পাটঠাইনইঞ্চে। চলেন।”, দোকানের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো। “কে?!!” — সাবধানী আমি। “আমি গোবিন্দ বটি, চলেন ক্যা নে!”, সাদা ধুতি, খালি পা, খালি গা … এ হেন গোবিন্দ কে অনুসরণ করতে যে কোনো কুণ্ঠা বোধ হয় নি, তা নয়। তবে, মন বললো, “আধা ঘন্টা – এক ঘন্টার ছোট্ট মোলাকাত, এত চিন্তার কি আছে?
”            ঝকঝকে গলি, মাটির বাড়ি, ঢুকতেই লাল মাটির উঠোনের ওপর গোবর ল্যাপা তুলসীর থান। আমাদের পা এর শব্দ পেয়ে দৌড়ে এলো সবাই। সর্বপ্রথম লালমণি। উঠোনে খাটিয়া ও কয়েকটা মোড়া আগে থেকেই রাখা ছিল। আমরা উঠোনের কোণে রাখা মাটির কলস গরিয়ে হাত – পা ধুয়ে নিলাম। সকলে এমন ভাবে তাকিয়ে রইল যে আমরা পদধূলি দিয়ে ওদের কৃতার্থ করেছি। মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পেরে যে আমার খারাপ লাগছিল তা একেবারেই নয়। অদ্ভুত একটা মেঠো সারল্য, একটা গ্রামীণ অকৃত্রিম ভালোবাসা মন কে ঘিরে ফেললো অচিরেই।
               ফুল দিদা সাদা ধপধপে শাড়ির আঁচল বিছিয়ে বসে এক ধামা মুড়ি মাখতে বসলো। কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা কুচি, আচারের তেল দিয়ে বেশ করে মাখলো। দিদার বড় বউ ততক্ষনে লোহার কড়াই তে ঘরে – গড়া আলুর চপ তেলে ভেজে তুলছে আর ছোটো বউ হামান দিস্তায় আদা থেঁতো করে গরম চা এর কেটলী তে ঢালছে। আমার মেয়ে কে দেখি দিব্যি লালমনির সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। আহ্লাদের চোটে লালমণি, কালো ল্যাজ নেড়ে মটর শুটির খোসা চিবোতে ব্যস্ত আর আমার মেয়ে বেমালুম তার পিঠের সাদা লোমে হাত বোলাতে বোলাতে, সে কি আদর! ছাগ শিশু ও মানব শিশুর বন্ধুত্বের এক নতুন সংজ্ঞা, এক নতুন অবয়ব আবিস্কার করে আমি একেবারে গদগদ। চা মুড়ি ও আলুর চপ যে এত সুস্বাদু হতে পারে, ফুল দিদা র মেহমান না হলে জানতে পারতাম না কোনোদিন।
            কথায় কথায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। তুলসীর থান এ পিদিম জ্বলে উঠল। সাথে শঙ্খ ধ্বনি। মা বললেন, “আজ আমরা আসি।” বাবা উঠে সদর দরজার দিকে এগোবার আগেই ফুল দিদা দৌড়ে এলেন মা এর কাছে, “বৈল্ ছিলোম কি… রেত্তে ইয়ালপো কইরে বিউলির ডাল দেঁয়ে আলু – পোসতু খাইয়েন যাও ক্যানে?” । ভালোবাসা সবসময় রক্তের সুত্র খোঁজে না, কিছু সম্পর্ক এমনি এমনিই গড়ে ওঠে। সংযোগ ছাড়াই। হঠাৎ এই উপলব্ধির মাঝে, মা যে উত্তরে ফুল দিদা কে কি বললেন শোনা হল না। আনন্দে, আবেগে আমার কর্ণ – নাসিকা বেমালুম কাজ – কাম বন্ধ করে দিয়েছিল কিছুক্ষন। আমি মেয়ে কে ভেতরের ঘরে ডাকতে গিয়ে দেখি ও লালমণি র পিঠে চেপে বসে চুপ চাপ টিভি দেখছে!  “ওমা! লাল মণি তো বেশ মন দিয়ে খবর শুনছে দেখি”, হাসি চাপতে না পেরে বললাম। “হ দিদি, থাইকতে থাইকতে উ ও মানুষ হইং গ্যাছে আমাদের পারা। ঐন্য ছাগল ডেইকলেই পোলায় …”, গোবিন্দ সত্য ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজেই হেসে কুটিপাটি।
              পরের দিন টিও আমরা পুরুলিয়ার টানে হোটেলেই রয়ে গেলাম। হঠাৎ জনতা কারফিউ ঘোষণা হল। তার পরের দিন, আধ বেলার ছুট পাওয়ায়, ছুট মেরে কোলকাতা হাজির হলাম। পরের দিন থেকে শুরু হল লক ডাউন বন্দি দশায় বারবার লালমণি র পরিবারের কথা মনে পড়ে। এত সামান্য তে যাঁরা আনন্দে থাকে, আনন্দে রাখে, তাদের কে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে কার সাধ্যি ? বেশির ভাগ ভাইরাস ই যে আমাদের মনে।
                … লাল পলাশের দেশের লালমণি, ভালো থেকো।

4 thoughts on “গল্পঃ মধুপর্ণা রায়

  1. সুন্দর লাগল।সহজ সরল কিন্তু আকর্ষণীয়।❤️🙂

Leave a Reply to PRABIR GANGULY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *