ছোটগল্পঃ ভেদ – কৃত্তিকা ভৌমিক

 ভেদ
 কৃত্তিকা ভৌমিক

আজ ১৮ ই আষাঢ়। খুব শুভ দিন। একথা তিথি জানে। কারন তিথিকে তার মা বলেছে। 
শুভ তো হতেই হবে। আজ যে দাদাভাই এর বিয়ে। মা বলেছে শুভদিন, ভালো দিন দেখে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হয়। আর তিথি তো একথা জানে যে দাদাভাই এর বিয়েতে সব কিছুই  মঙ্গল হতে হবে।
 তিথির দাদাভাই যে বড্ড ভালো। কত্ত  পড়াশোনা ক’রে দাদাভাই এখন শহরে চাকরি করে। তিথির অবশ্য শহর মোটেই ভালো লাগে না। কাকুমনি থাকে বড় শহরে। কাকুমণির বাড়িতে যখন যায় তখন দুদিন থাকলেই তার মনে হয় কখন গ্রামে ফিরবে। 
শহরে খেলা করার মাঠ নেই, নদী নেই, বোসেদের বাড়ির ঠাকুর দালান নেই, ঝুরি নামা বটগাছ নেই, নদীতে ঝাপাঝাপি করে স্নান করা নেই। শুধু একটাই ভালো জিনিষ আছে, সেটা হল জিনি। তার থেকে একবছরের ছোট বোন জিনি। তার কাকুমনির একমাত্র মেয়ে। 
কাকুমণিও খুব ভালো কিন্তু কাকিমা যেন একটু কেমন কেমন। একটু রাগী। অত রাগী মানুষ তিথির ভালো লাগে না। তার মা কত ভালো, একটুও রাগ করে না। কাকিমা কেবলই জিনি কে বকে। আর তিথি ওদের বাড়ি গেলে তার সবকিছু কাজকেই খারাপ বলে। তাই ককিামাকে তার ভালো লাগে না। অবশ্য মা বলেছে বড়দের সম্পর্কে অমন কথা বলতে নেই।
                      যাকগে যাক, আজ বিয়ে বাড়িতে সবাইকেই তার ভালো লাগছে। কত আনন্দ। সানাই বাজছে, ভিয়েন বসেছে মিষ্টি বানানোর জন্য। কত মানুষ, হৈ চৈ। 
আজ কাকিমাও কেমন হাসি খুশি, সুন্দর। জিনি একটা সুন্দর ফ্রক পড়েছে। তিথি কিন্তু শাড়ি পড়েছে। শহর থেকে  বিয়ে উপলক্ষে দাদাভাই  এনে দিয়েছে। সেটা পড়ে দশ বছরের তিথিকে নাকি পাকা বুড়ি লাগছে, সবাই তাই বলছে। রাত্রে অবশ্য তিথি অন্য পোষাক পড়বে। সকালে তো শাড়ি পড়তেই হবে। বড়দের সাথে জল সইতে যেতে হবে তো! তিথির বায়নায় মা রাজি হয়েছে শুভকাজে নিয়ে যেতে।  মা তিথি কে বলেছে ছোট ঘড়া নিয়ে সে-ও নদী থেকে জল নিতে পারবে। তার দাদাভাই এর বিয়ে বলে কথা। ঠাকুর ঘর থেকে ছোট্ট ঘড়াটা নিয়ে সে-ও তৈরি নদীতে যাওয়ার জন্য। 
তিথির সাথে তার অন্যান্য বন্ধুরাও যাবে নদীতে। আর যাবে বুলা আর জবা। আরতি পিসি তাদের বাড়ি কাজ করে। তারই মেয়ে বুলা আর জবা। তারাও পড়েছে নতুন জামা। বিয়ে উপলক্ষে মা তাদের এই নতুন জামা দিয়েছে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙেনি বলে তিথি বড়দের সাথে গঙ্গা  নিমন্ত্রণ করতে যেতেই পারেনি। তাই সে এখন আগেই তৈরি হয়ে বসে আছে। 
জিনির দেরি হচ্ছে দেখে ছোট্ট ঘড়াটা হাতে নিয়েই সে জিনিকে ডাকতে গেল। কিন্তু তাদের ঘরে ঢোকার মুখেই সে শুনতে পেল কাকিমা জিনিকে বকছে। বলছে, কাজের মেয়েদের সাথে নদীর ঘাটে যাওয়ার দরকার নেই। এইসব গ্রাম্য কালচার নাকি তার পছন্দ নয়। 
তিথি থেমে গেল। ঘরে ঢুকতে পারলো না। সে ভাবল, বুলা আর জবার বাবা নেই ব’লে তাদের মা লোকের বাড়ি কাজ করে। তাই ব’লে আনন্দের দিনে সকলের সাথে তারা আনন্দ করবে না!! এতে তো তাদের বাড়ির অন্য কেউ খারাপ বলেনি। তাহলে কাকিমা এতো ভেদাভেদ করে কেন! সব মানুষকে খুব তুচ্ছ করে। কাকুমণি কিন্তু এমন নয়। আর জিনিও তো ওদের সকলকে খুব ভালবাসে! জিনি না গেলে যে ওদের আনন্দটাই পুরো হবে না। কিন্তু কাকিমা কে কিছু বলার সাহস তিথির নেই। 
                         তিথি কাকিমার ঘরের সামনে থেকে ফিরে এলো। একটু পরে দেখল কাকিমা হাসি মুখে সবার সাথে পা মিলিয়ে নদীতে চলেছে। জিনি কে কাকিমা ঘরের বাইরে আসতে দেয় নি। এই আনন্দের মাঝেও জিনির জন্য একরাশ মন খারাপ নিয়ে সকলের সাথে নদীতে গেল তিথি। 
দাদাভাই এর মঙ্গলের জন্য তো তাকে যেতেই হবে। নদীর ঘাটে বড়দের ভিড়ে তিথি সুযোগই পাচ্ছে না জল ভরার জন্য। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল মকবুল চাচার ছোট্ট ডিঙিটা ঘাটে বাঁধা। তিথি এগিয়ে গিয়ে সেই ডিঙি তে উঠে দাদাভাই এর মঙ্গলের জন্য ঘড়ায় জলটা ভ’রেই নিল। 
তার ছোট্ট ঘড়াটায় জল ভ’রে সে নদীর ঘাট থেকে উঠে আসার সময় ভাবল, এই নদীতেই তো সে, বুলা, জবা আরও সবাই স্নান করে, কই তাদের গ্রামের কেউ তো বলে না যে ওরা কাজের মেয়ে এখানে কেন?? আর তাছাড়া কাকুমনি আর কাকিমা যখন অফিসে চলে যায়, জিনি কে তো তাদের কাজের মাসিই যত্ন করে খাওয়ায়, আগলে রাখে, তখন কেন কাকিমার খারাপ লাগে না!! সকলেই তো মানুষ।  
অনেক প্রশ্ন  মাথায় ঘুরতে থাকে তিথির। ভাবে বিয়েটা মিটে গেলে মা কে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবে। এখন সকলের সাথে তিথি পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। উলু আর শঙ্খ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল নদীর ঘাট। তাড়াতাড়ি যেতে হবে, জিনি তাদের পথ চেয়ে আছে।।

10 thoughts on “ছোটগল্পঃ ভেদ – কৃত্তিকা ভৌমিক

  1. খুব সুন্দর হয়েছে। আগামী তে অপেক্ষা য় থাকবো।

  2. খুবই প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় নিয়ে গল্পটি।খুব ভাল ।

  3. “ছোট প্রান ছোট কথা,ছোট ছোট দুঃখ ব্যাথা,,,,,৷৷ ”
    খুব সুন্দর হয়েছে ” ভেদ “লেখাটি

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী। Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *