ব্রিফকেস
দেবাশিস রায়
ভদ্রলোকটির হাবভাব একটু কেমন যেন। একটুখানি জায়গায় বারবার পায়চারী করছেন। দশ পা হেঁটে গলির মুখ অবধি যাচ্ছেন। একটু দাঁড়াচ্ছেন। এপাশ ওপাশ দেখছেন। আবার গলির এপ্রান্তে ফেরত আসছেন। এ প্রান্তে এসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
মাঝ বয়স্ক। বছর চল্লিশ হবে। বুগলুর ছোট কাকার বয়সী। চেহারাতেও বেশ মিল আছে। পেছনে করে উল্টে চুল আঁচড়ানো। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। গুঁজে জামা পড়া। পায়ে ছোটকার মতোই কালো ছুঁচলো মুখের জুতো। হাতে সামান্য পেটমোটা একটা কালো ব্রিফকেস। অফিস যান যারা তাঁদের কারো কারো হাতে এমন ব্রিফকেস দেখেছে সে। বুগলু প্রথম দর্শনে একটু চমকে গিয়েছিল। পেছন থেকে দেখলে একদম এক। সামনের দিক থেকে দেখলেও মিল প্রচুর। একটা জায়গায় একটু তফাৎ। সেটা উচ্চতায়। বুগলুর ছোটকা বেশ লম্বা। আর এই ভদ্রলোক মাঝারী উচ্চতার। পথে ঘাটে এমন কতই মানুষ চোখে পড়েন। কে আর কাকে খেয়াল করছে। কিন্তু এই ভদ্র লোকটিকে খেয়াল করতে সে এক রকম বাধ্য হয়েছে। কারণ ওই ছোটকার সাথে ভীষণ মিল। আর তার পরে ওনার এই রহস্যজনক চালচলন। হাঁটছেন। দাঁড়াচ্ছেন। দেখছেন। আবার ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই মুহূর্তে বুগলু আটকে পড়লো এই আলু পেয়াজের আড়তে ভরা গলিটায়। ওর চোখ দুটো এখন আটকে রয়েছে ভদ্রলোকটির ওপর।
যাচ্ছিল খেলতে। গলিটা পেরোলেই বড় রাস্তা। তার ওপারে ওদের খেলার মাঠ। সে সব মাথায় উঠলো। ওর মনের মধ্যে এখন রহস্য অনুসন্ধানীর কৌতূহল। ফিলিং গোয়েন্দা গোয়েন্দা। খেলতে যাচ্ছিল বলে পকেটে মোবাইলটা নেই। ক্লাশ নাইনে ওঠার পুরস্কার। এদিক ওদিক পড়তে যায়। খোঁজ খবর রাখবার জন্য এই বছরই ছোটকা ওটা কিনে দিয়েছে। বাড়িতে একটা আপত্তির ঝড় উঠেছিলো। কিন্তু ছোটকার অকাট্য যুক্তির সামনে ওসব আপত্তি ধোপে টেঁকে নি। এখন ওটা বুগলুর সর্বক্ষণের সঙ্গী। থাকলে বেশ হত। লোকটার ছবি তুলে রাখা যেত। ছোটকাকে ফোন করে জানানো যেত, মতামত নেওয়া যেত। নেই যখন তখন আর হাহুতাশ করে কি হবে? আপাতত একটু আড়ালে যাওয়া যাক। ভদ্রলোকটি খেয়াল করেছেন বুগলুর উপস্থিতি আর কৌতূহলী নজর। দু একবার ওর দিকে তাকালেন। তারপর অবশ্য ওর বয়স এবং খেলার পোশাক দেখে ওকে আর গুরুত্ব দিলেন না। যেমন পায়চারী করছিলেন, করতে লাগলেন। আচমকাই বড় রাস্তার দিক থেকে একসাথে চার পাঁচজন নানা বয়সের ভদ্রলোককে দেখা গেলো ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে এই গলির মধ্যে ঢুকলেন। ওনাদের দেখে এই ভদ্রলোকটি কিছু একটা বলতে বলতে ওনাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। কি বলছেন সেটা বুগলু শুনতে পেলো না। সে আপাতত একটা আলু বোঝাই ট্রাকের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে। আচ্ছা, এরা ডাকাত নয়তো? ভদ্রবেশি ডাকাত। বোঝা মুশকিল। খবরের কাগজে অবশ্য বুগলু মাঝে মধ্যে পড়েছে। অমুক মাঠ থেকে বা অমুক এলাকা থেকে বেশ কয়েকজনকে পুলিশ ধরেছে। ডাকাতি করবার উদ্যেশ্যে তারা জড় হয়েছিল। বুগলু এও শুনেছে যে এই আলু পেঁয়াজের গদিগুলোতে নাকি লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়। সারা সকাল যা ভিড় থাকে গলিটা। তখন হাঁটা দায় এই রাস্তায়। পুরো সকালের বেচাকেনার টাকা হয়তো অনেক দোকানেই রয়েছে। এখনও ব্যাঙ্কে জমা দিতে যায় নি। তবে কি? ভাবতেই গায়ে শিহরন উঠলো বুগলুর।
এই ঠিক দুপুর পেরোনো সময়টা এলাকা শুনশান থাকে। রাস্তা ঘাট একটু ফাঁকা। ঐ পাঁচ ছ জন মানুষই কেবল এক জায়গায় জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বুগলু দেখতে পেলো আস্তে আস্তে আরও কয়েকজন এসে ঐ জটলার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। গুনে দেখল এই মুহূর্তে ওঁরা ঠিক দশজন রয়েছেন। এত বড় কি ডাকাত দল হয়? বুগলু বুঝতে পারছে না কিছু। এবার ঐ ব্রিফকেস হাতের ভদ্রলোকটি সামনের আলুর গদিতে ঢুকলেন। বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করছেন। উত্তেজনায় বুগলুর দম আটকে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন গদির ভেতর থেকে। সঙ্গে একজন মুটে। এক বস্তা আলু টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে সে। সবাই এখন আলুর বস্তাটার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। ভদ্রলোকটি এবার ওনার ব্রিফকেস খুলছেন। নাহ। কোন অস্ত্র শস্ত্র নয়। বুগলুর বিস্ফারিত চোখ দেখতে পেলো ভদ্রলোকটি নিজের ব্রিফকেসের ভেতর থেকে একটা ওজন করবার দাঁড়িপাল্লা আর একটা বাটখারা বের করলেন। বস্তা খুলে চটপট ওজন করে করে সবার ব্যাগে আলু ভরে দিচ্ছেন। প্রত্যেকেরই পকেটে বাজারের ব্যাগ ছিল। আলুগুলো ব্যাগে ভরে নিয়ে যে যার মতো হাঁটা দিলেন। ভদ্রলোকটি এবার দাঁড়িপাল্লা আর বাটখারা ব্রিফকেসে ভরে নিয়ে গলির ওপ্রান্ত দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে আলুর খালি বস্তাটা পা দিয়ে রাস্তার একপাশে সরিয়ে দিয়ে গেলেন। ঘরে ফিরে ছোটকাকে বলতে প্রথমে ছোটকা বিশ্বাস করে নি। পরে চিন্তা করে বলল, “ বুঝলি, বস্তা হিসেবে কিনলে আলুর দাম বেশ কম পড়ে। ওখানে যারা ছিলেন, কারো দু পাঁচ কিলোর বেশী হয়তো প্রয়োজন নেই। গদি আবার বস্তা ছাড়া বেচবে না। বুদ্ধি করে ঐ ব্রিফকেসওয়ালা ভদ্রলোক মাঝে থেকে ওনাদের কম দামে আলু কেনবার বন্দোবস্ত করেছেন। সাথে নিজেরও কিছু উপার্জন হয় নিশ্চয়ই। বুদ্ধি থাকলে উপার্জনের অনেক রাস্তা আছে। ওভাবে ঘুরে ঘুরে আলু বিক্রির টাকায় হয়তো ঐ ভদ্রলোক সংসার পালন করছেন। ” বুগলু হাঁ করে ছোটকার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ছোটকার কথার মাথামুণ্ডু সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি।
দারুন।
ভাল লাগল বেশ।
দারুণ লাগলো গল্পটা।