অচেনা আমি
ভূমিকা গোস্বামী
আমি কি করে যে পাল্টে গেলাম ! তিরিশটা বছর ধরে যে আমি আমার এই শরীরটা দখল করে বাস করছিল। যাকে আমি চিনতাম। এ যেন সেই আমি নয়। অন্য কেউ।
গতকাল থেকে পরিবর্তনটা নিজে বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনাদের কি করে যে বোঝাই বুঝতে পারছি না।কোথা থেকে শুরু করব তাও বুঝতে পারছি না।
মাস দুয়েক আগের একটা দিন জুলাই মাসের প্রথম দিকে–হঠাৎ পল্লবী এসে হাজির। প্রয়োজনে ও প্রায়ই আসে। ওর নাচের একটা প্রোগ্রাম হবে যুব সংঘের মাঠে। আমার বিয়ের বেনারসীটা দিতে হবে। এর আগেও ক’বার নিয়েছে। প্রতিবারই কিছু না কিছু গন্ডগোল করেছে। এবার একেবারে শাড়ির পাড়টা ছিঁড়ে ফিরিয়ে দিয়ে গেল। মনে কষ্ট পেলেও মুখে হাসি রেখে ওর কাছ থেকে শাড়িটা নিয়েছি।
ও বলতে চেয়েছে আমার এই পচা শাড়ির জন্য ওর নাচের ব্যাঘাত হয়েছে। আমি অপরাধী অপরাধী মুখে বলেছি– পাঁচ বছর আগের পুরোনো তো , হয়তো…..
– না না , ভাল দোকান থেকে কিনতে পারো নি। আজেবাজে জায়গা থেকে কিনলে এমনই হয়।
আমার বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠেছিল ওর কথায়। কারণ এই শাড়িটা
আমার বিয়েতে যে দিয়েছিল সে আজ নেই। আমার দাদার বন্ধু ছিল অসীমদা। ওর কাপড়ের দোকান ছিল।আমার বিয়েতে সব শাড়ি ওর দোকান থেকেই এসেছে। বিয়ের বেনারসী ও গিফ্ট করেছিল। বলেছিল –আমার দোকানের সেরা বেনারসী পরেই বোনের বিয়ে হবে। বছর খানেক আগে বাইক এ্যক্সিডেন্টে….
যাইহোক, কয়েকদিন আগেই রিপু হয়ে নতুন হয়ে দোকান থেকে ফিরেছে শাড়িটা। আমাকে আমার বাড়ির লোকজন পই পই করে বলেছে, এমন করে নিজের সব জিনিস না দিয়ে দিতে। কিন্তু আমি তো নরম মনের মানুষ।
আমি দেখেছি, কেউ যখন তার দরকার নিয়ে আসে , তখন আমি একদম গলে যাই। তাকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। করতে না পারলে
মনকষ্টে ভুগি।
এরকম ভাবে বর্ষাকালে বাড়ি থেকে দু পা এগিয়েই ছাতার দরকার হয় কারো। শীতকালে চাদরটা। গানের স্বরলিপির সহ বিভিন্ন বই বিভিন্ন সময়ে অন্যের প্রয়োজন মিটাতে আমার বই এর আলমারী ফাঁকা হতে থাকে। কেউ আবার বাজারের থলি নিয়ে টাকা আনতে ভুলে আমার কাছে চলে আসে।
তারপর দীর্ঘদিন যায় কোনটা কাকে দিয়েছি মনে করতে পারি না।
শুধু কি তাই ! পাড়ার ছেলেরা ফিস্ট করবে , কলা পাতা কাটতে কাটতে বলে– বৌদি , পাতা নিচ্ছি। আমি না বলতে শিখি নি। তাই মাত্র দুটো কলাগাছে চারটে পাতার দুটো পাতাই নিয়ে যাচ্ছে দেখে চুপ করে থাকি।
দেবদেবীর সন্তানরা প্রতিটি পুজোয় মূর্তি আনা থেকে ভাসান পর্যন্ত নির্ভুল করে স্মরণ করে বহন করতে পারলেও ঘটের সশীষ ডাবটি তাদের আনতে ভুল হয়ে যায়-ই। তড়িঘড়ি এসে আমার একটি মাত্র নারকেল গাছে চড়াও হয়।
শিউলি গাছ আর গাঁদাল গাছটি যতদিন ছিল, প্রতিবেশীদের বায়ু পিত্ত কফের প্রবণতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে দেশের কল্যাণকামী নাগরিক হিসেবে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।
বেশ কয়েকদিন ধরে লাল গোলাপ গাছে কুঁড়িটা ধরেছে। ফুটি ফুটি করেও ফুটছে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে দেখি। ডিমের খোসা আর চায়ের পাতা ভাল করে মেখে রোজ সকালে দিচ্ছি। আর গুন গুন করে গেয়েছি – বল গোলাপ মোরে বল, তুই ফুটিবি সখী কবে।গতকাল সকালে ও প্রথম পাপড়ি মেলেছে।
গতকাল দুপুরে, স্নান খাওয়া সেরে সবে আমার ছোট্ট বাগানে এসে দাঁড়িয়েছি। পল্লবী হঠাৎ এল। বললাম , কোথা থেকে ? সেই আগের সুর আগের ঢঙে বলল — আজ বিকেলে আমার বন্ধুর বিয়েতে যেতে হবে। পার্লারে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময়ই দেখেছি আমার শাড়ির রঙের গোলাপটা ফুটেছে । বৌদি দাও তো গোলাপটা। তাড়াতাড়ি কর। আমার আবার….
মুহূর্তে পাল্টে গেলাম আমি। ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট করে বললাম — না , ওটা তোমার জন্য নয়। মনেমনে বললাম–দীর্ঘ অপেক্ষার পর যা পেয়েছি তাকে কি চাইলেই দিয়ে দিতে হয় !
তখনই বুঝলাম জানেন ! আমার পূরোনো চেনা আমিটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে । এই আমি এক অন্য আমি। অচেনা আমি।
দারুন লাগলো ।
খুব ভালো লাগল।বাস্তব সত্যি না কে না বলতে শেখা। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জীবনে।একদিক থেকে ভাল থাকার চাবিকাঠি । ধন্যবাদ লেখিকাকে।💐
Khub valo laglo.
ভীষণ ভালো লাগলো। কিন্তু এই অচেনা আমি হওয়া বড়ো কঠিন কাজ।
ছোটগল্পের রীতি মেনে অপূর্ব জীবনকথার এক ঝলক দর্শন। বাঃ।
গুণী পাঠকের মূল্যবান মন্তব্যে আমি অনুপ্রাণিত। সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।