জীবন কথাঃ নিজের সঙ্গে কথা – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

নিজের সঙ্গে কথা
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

হ্যাঁ, এবার নিজের কথাই বলবো । নিজের কথা বলার হয়তো এখনও সময় হয়নি। বিশেষ করে আমি এই মুহূর্তে মৃত্যু শয্যায় শুয়ে নেই। কিন্তু যদি সে অবস্থায় থাকি তা ভেবে নিতে চাই। যেমন ধরুন আমি শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর দিনক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছি আর ভাবছি কবে হবে সেই শেষদিন।
তিনি এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন, হঠাৎই। চেনা চেনা মনে হচ্ছে, তবু চিনতে পারছিনা। অচেনা মানুষ জনদের অবজ্ঞা করিনা। এটা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সেই উনিশ শ একাত্তর সালে পাড়ার দুজন যখন মদ্যপ অবস্থায় দুটো পাইপ গান নিয়ে আমার বুক ছুঁইয়ে নানা রকম বাচনে আমার মৃত্যু আসন্ন বলে তড়পাচ্ছিল তখনও আমি তাদের বলেছিলাম – তোমরা বসো, একটু জল খাও, ছুটে আসছ, ঘেমে গেছ, বিশ্রাম করে নাও।’
আর এক্ষেত্রেও তো প্রায় চেনা লাগছে এমন কেউ এসেছেন। তবে, তাঁর হাতে কোন মারণাস্ত্রও নেই। তাঁকে বললাম – বসুন, কোত্থেকে আসছেন ?”
তিনি বললেন – কোত্থেকে আবার ? তোমার কাছ থেকেই।” এবার আমার অবাক হবার পালা। ঘরের দরজাও বন্ধ, তাঁর আসা তো দরজা দিয়ে হয়নি। তবে তিনি আমার ভেতর থেকে এসেছেন ?
তিনি আবার বললেন – কী ভাবছ ? আমি সবার ভেতরে আছি, থাকিও। এবার চিনতে পারছতো ?”
তাঁকে চেনা চেনা লাগলেও কক্ষনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এবার তিনি আমার সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। হয়তো আমিই বসতে বলতাম । কিন্তু আমার দেরী করে বলার জন্য অপেক্ষা করলেন না। সুন্দর তাঁর মুখশ্রী। মনে হচ্ছে পৃথিবীর যত সৌন্দর্য আছে সব একসঙ্গে দলা পাকিয়ে তৈরি একটা বিশেষ শ্রী তাঁর মুখে রাখা আছে, বা তার চেয়েও বেশী। আরও মনে হচ্ছে, এই বিশেষ শ্রী থেকেই কিছু কিছু টুকরো দিয়ে আমি, রামবাবু, রহিমবাবু, বা নাম না জানা মানুষরা, মহিলারা রূপ সৌন্দর্যের বড়াই করি। ভাবি, এই পৃথিবীতে আমিই আছি, থাকবো চিরদিন। থাকবো আমি, আমিই। থাকবেনা ওরা, থাকবেনা তোমরা। এই জগতটা ভোগ করার জন্য। আর আমারই ভোগ করার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সেই জগৎ শুরু হবার দিন থেকে। আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন- কীহে, কী ভাবছো ? আমাকে বসিয়ে রেখে ভেবে যাচ্ছ ? তাহলে আমি যাই।”

  • কোথায় যাবে ? আগে তো নিজের পরিচয় দিয়ে যাও।”
    তিনি তাঁর জগতমোহিত করা নীরব হাসিটুকু ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলিয়ে রেখে বললেন- তুমি তো বুঝতেই পারছ আমি কে? বুঝেও না বোঝার ভাণ করছ কেন?”
    “আচ্ছা মজা তো। সব বোঝা কী যায়?” বললাম আমি, – বিশেষ করে নাম বোঝা যায় না। আন্দাজে বোঝাও ঠিক নয়। তোমার নাম যা কিছু হতে পারে। হতে পারে রাম রহিম যীশু শম্ভু অলোক কমল হাব্লু কাব্লু যা খুশী।”
  • বা বাঃ, সারটা বুঝেছ !”
    নাঃ । তিনি আর নেই। কোন্‌ দরজা দিয়ে গেলেন ! সবতো বন্ধ। তবে কি তিনি বা সে বা কেউই আসেনি ? সবই আমার মনের ভুল ?
    হ্যা, মনের ভুল হয় মাঝে মাঝে। আজকাল প্রায়ই হয়। এই ভুল হওয়াটাকে বন্ধুরা এলঝাইমার বলে । এগুলো নাকি বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কিত ! যেমন, অনেক কষ্ট করে দোতলার ঘরে যেখানে বই পত্তর থাকে সেখান থেকে একটা নীল মলাটের বই নিয়ে আসতে গেলাম, বইটা আনার কথা ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে ভুলে গেলাম, হাতে কলমদানির ভেতর থেকে উঁকি দেয়া নেল কাটারটা নিয়ে একতলার ঘরে ফিরে এলাম। নীল মলাটের বইটার কথা নীচের তলায় এসে মনে পড়ল। আবার উঠতে হবে! পায়ে যে ব্যাথা !
    এব্যাথা জরা এলেই হয়। সেই কোন্‌ সুদুর অতীতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ মানুষের ঘরে একশ পঁচিশ বছর লীলা সাঙ্গ করে, স্বধামে চলে যান। যাবার আগে নিজের ক্রমবর্ধিত অবাধ্য অত্যচারী যদু বংশ প্রায় ধ্বংস করে রোহিণী পুত্র বলরামের সমুদ্র তটে শরীর ত্যাগ করার পর, ফিরে যাবার অপেক্ষায় এক পিপ্পল গাছের তলায় শ্রান্ত অবস্থায় বসেছিলেন। তখন তিনি তাঁর চতুর্ভুজ অপূর্ব সৌন্দর্যে মূর্তিতে ছিলেন। এই চতুর্ভুজ মূর্তিতেই তিনি কংসের কারাগারে দেবকীনন্দন রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
    মা দেবকীর অনুরোধে তিনি এই পৃথিবীর সব মানুষের রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন, এবার ফিরে যাবার সময়ও তিনি আবার চতুর্ভুজ মূর্তিতেই ফিরে যাবার অপেক্ষায় ছিলেন। দূর থেকে তাঁর সুন্দর রক্তিমাভ পদতলকে হরিণের মুখ ভেবে ভুল করে এক ব্যাধ অভিশপ্ত মুষলের অবশিষ্টাংশ দিয়ে তীক্ষ্ণ করে বানানো তীর নিক্ষেপ করেছিল। সেই ব্যাধের নাম ছিল জরা। বুঝতে পেরে অবশ্য জরা নামক ব্যাধ দৈত্য দলন শ্রীকৃষ্ণের চরণতলে লুটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু, মনুষ্যরূপী শ্রীকৃষ্ণের তাতেই এই সংসার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তাঁর কৃপায় জরা ব্যাধ স্বর্গে আরোহণ করল আর তিনিও ভগবানের পতাকা ও অশ্বযুক্ত গরুড়ধ্বজ রথে স্বধামে চলে গেলেন।
    আমাদের ক্ষেত্রে, যাওয়াটা অন্যরকম হলেও স্বাভাবিক বয়োঃবৃদ্ধি হলে মৃত্যুর আগে জরা আমাদের ধরবেই, কারোর ষাট-সত্তরেই জরা আসে এবং সেই জরা ব্যধির প্রকোপে এখন আমরা মৃত্যুর অপেক্ষা করে থাকি, কেউ একবছর বা তারও বেশি সময় ধরে আত্মীয় স্বজন, বিশেষ করে কাছের জনকে নানান বায়নাক্কার আবদার করে বা যখন তখন মলমূত্র ত্যাগ করে একেবারে নাস্তানাবুদ করি । একান্ত প্রিয়জনও তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন – হে প্রভু, ওঁকে আর কষ্ট দিয়োনা, ওঁকে এবার যেতে দাও বা তোমার কাছে নিয়ে যাও। এটা মানুষের বিশ্বাস তিনি নিয়ে যান। এবিশ্বাস অনন্তকাল থেকে চলে আসছে।
    এক্ষেত্রে কী আর করা যায়! তবে, কিছু একটা করতে হবে, কিছু করার মধ্যে থাকতে হবে। জমানো অভিজ্ঞতা গুলিতো বিলি করতে পারি। এখন দেখি আমার সারা জীবনের বিচিত্র অজস্র অভিজ্ঞতার কোন অংশ যদি কারো কোন কাজে লাগে। তাই না?
    কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলল – ঠিক বলেছিস ব্যাটা।” কে বলল দেখার জন্য ঘাড় এদিক ওদিক বাঁকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না।

7 thoughts on “জীবন কথাঃ নিজের সঙ্গে কথা – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

  1. অসাধারণ উপলব্ধি, আপনার আরও অভিজ্ঞতা গল্প রুপে পাঠ করতে চাই।

  2. বেশ মজা করে জীবনের চিরন্তন সত্যকে তাঁর সক্ষম লেখার মধ্যে ফুটিয়ে ছেন।

  3. অসাধারণ উপলব্ধি । খুব ভালো লাগলো । আরও পড়ার অপেক্ষায় রইলাম ।

    1. Someone came knocking
      At my wee, small door ;
      Someone came knocking ;
      I’m sure-sure-sure ;
      I listened, I opened
      I looked to left and right,
      But nought there was a stirring
      In the still, dark night ;
      So, I know not who came knocking
      At all, at all, at all.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *