বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কাছে কতটা স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলা ভাষা?
সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ দিন। বলা হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ এর জন্ম সূচনা হয়েছিল। দেশভাগের ক্ষত নিয়ে পাকিস্তানের হাত থেকে নিজের মাতৃভাষা কে যেভাবে উদ্ধার করেছে,বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ,ভাষা ও জাতির প্রতি অত্যন্ত ভালোবাসা না থাকলে এই আন্দোলন করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে নিজেদের সবার আগে রাখতে পেরেছে। যে আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে ভাষা সৈনিকেরা আত্মাহুতি দিয়েছিল সেটাই বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে যে সাহায্য করেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই একেবারেই।
ইউনেস্কোর মতে ১০,০০০ এর কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই হিসেবে ভারতে এখনও পর্যন্ত পাওয়া ৭৮০ ভাষার মধ্যে বিপদ সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৬০০টির । এবং জানা যাচ্ছে গত ৬০ বছরে প্রায় ২৫০ ভারতীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ভারতবর্ষে বাংলাভাষা কেমন আছে আজ?
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে কতটা স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলা ভাষা?
আমাদের দেশে এখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে।দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দু’দিক রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের না হচ্ছে ভাল করে ইংরেজি শিক্ষা, না হচ্ছে মাতৃভাষার শিক্ষা। বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে চলনসই ইংরেজি ভাষা শিক্ষাই মুখ্য হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীদের কাছে। অর্থাৎ বিদেশি ভাষা শেখার জন্যও যে মাতৃভাষা ভাল ভাবে শিখতে হয়, এ বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে না বেশিরভাগ পড়ুয়াদের কাছে। অথচ প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য এটাই যে, যার যার মাতৃভাষায় শিক্ষা পাওয়ার মধ্য দিয়েই একটি জাতি সামগ্রিক ভাবে এগিয়ে যেতে পারে।
এ তো গেল খাতায় কলমের কথা। এখনও পশ্চিম বঙ্গের বহু নাগরিক বাঙালিই আড্ডায়, আলোচনায় এমনকি নিজেদের বাড়িতেও ইংরেজি বলতেই বেশি ‘কমফোর্টেবল ফিল’ করেন। নতুন প্রজন্মও বিশেষ করে কলকাতাবাসী যেন সেই পছন্দের অনুসারী হয়ে বাংলার বদলে ইংরেজি ও হিন্দি, নয়তো এই দুটি ভাষা মিশিয়ে অদ্ভুত এক জগা খিচুড়ি বাংলা বলে।
এই বঙ্গের বর্তমান বাংলাভাষা এখন সিনেমা, টিভি সিরিয়াল, সাহিত্য যাকে আমরা সমাজের আয়না বলি সেখানে চোখ রাখলেই বুঝতে পারি। ভবিষ্যৎ ও অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।
এখনকার বাংলা সিনেমায়, সিরিয়ালে যেভাবে হিন্দি শব্দ,গান(যেন কোনও বাংলা গান নেই বঙ্গের ঝুলিতে, আমরা এতটাই আন্তর্জাতিক)ব্যবহার হচ্ছে তা সে যতই অর্থহীন হোক না কেন বা অর্থযুক্তই না হয় হল এসব দেখে শুনেও অপসংস্কৃতি ভেবে নেওয়া ছাড়া বিজাতীয় ভাষার এই যথেচ্ছ ব্যবহারেও আমরা কেমন নির্বিকার থেকে যাচ্ছি।
তাই আমাদের দেশে বাংলা ভাষা নিয়ে যুক্তি-তর্কে সভা-সমিতি, রেডিও-টিভির প্যানেল ডিসকাশন যতই সরগরম হয়ে উঠুক না কেন, পত্র-পত্রিকার পাতায় অবধি, ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ এই প্রবচনের জ্ঞান গম্ভীর প্রবন্ধেই তা সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সেই দুগ্ধের অভাব ঘটিয়ে কীভাবে আমরা নিজেরাই ভাষাকে অপুষ্ট-রিকেটি করে তুলছি – সেই ভাবনা আমাদের চেতনায় ঘা দেয় না কখনও।
অনেকের কাছে এখন বাংলা ভাষা চর্চা বা বাংলা বলার বিষয়টি উপহাস ও উপেক্ষার হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। এ ক্ষেত্রে কথ্য বাংলার মান যেমন নামছে, তেমনই নামছে লিখিত বাংলার উৎকর্ষতাও।
তাই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম নিয়মিত বই পড়ার পরিবর্তে প্রতিদিন অনেক সময় ব্যয় করেন ‘মোবাইল ফোন’, ‘ইন্টারনেট, ‘কম্পিউটার’, ‘ল্যাপটপ’, ‘হোয়াটসঅ্যাপ’, ‘গুগল’, ‘ফেসবুকে’। অনেকেই আবার আসক্ত ‘ভিডিও গেমে’।
সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চর্চা তো দূরের কথা, বই পড়ার সুযোগই মেলে কোথায়? উচ্চশিক্ষার প্রচলন বাংলায় তেমন নেই বললেই চলে। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়ত বাড়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।কিন্তু মানুষ হিসেবে জাতি ও ভাষার প্রতি যতটা অনুগত ও সৎ থাকা উচিত সেটা বোধহয় ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকছে।
স্বাধীনতার প্রায় ৭৫ বছর পরেও আজ ঘরে ঘরে বা পারিবারিক পরিসরে মানুষ এনিয়ে একটুও ভাবিত নয় সত্যি করে। শখের ভাবনায় শুধু উঠে আসে শখের বিলাপ। বাংলা টাংলা শিখে যে আন্তর্জাতিক ভাবে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। শুধু ওই একটু রবীন্দ্রনাথ নজরুল আওড়ানো ছাড়া। তাই নিজের সন্তানদের মাতৃভাষায় উচ্চ শিক্ষা নিয়েও এখন কারোর কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং তাঁরা চান, সন্তান তাড়াতাড়ি বিদেশি ভাষা শিখুক, তার পর দেশের বাইরে চলে যাক। এমনকি যাঁরা দেশে আছেন বা থাকবেন, তাঁদের অনেকের কাছেও বাংলা ভাষা চর্চা বা বাংলা বলার বিষয়টি উপহাস ও উপেক্ষার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ভাষা শহিদ দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য প্রকৃত অর্থে তাঁদের কাছে অজানা। ১৯শে মের কথা তো ছেড়েই দিলাম। ভাষা দিবস এখন শুধু একটি উৎসবে পরিগণিত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলে যতটা আমাদের ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপনের কথা মাথায় আসে তার এক অংশও ভাষাদিবসের কথা আসে না। বাজার অর্থনীতি এখানেই চূড়ান্ত ভাবে হারিয়ে দিচ্ছে একটা জাতিকে। তাই ইউনেস্কোর কাছে ২০১০ সালে বাংলা ‘পৃথিবীর সব চেয়ে মিষ্টি ভাষা’-র স্বীকৃতি পেলেও তার উচ্চারণে ভারতীয় বাঙালির নবীন প্রজন্মের বৃহদাংশের এত অনীহা দেখে আশঙ্কাই হয়, এই বুঝি বাংলা ভাষাকে তারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলে দেবে হয়তোবা।
মাতৃভাষার প্রতি যে কজন এলিটিস্টদের দরদ বাড়ে ফেব্রুয়ারি মাসে তার মধ্যেও থেকে যায় কিছু ভেস্টেড ইন্টারেস্ট। পুরস্কার ও নামী পাবলিশিং হাউজের থেকে যদি ওই বই বের করা যায় এসব আরকি।বাংলাভাষা কে ভালোবেসে একদিনের একটা রক্তদান শিবিরও যদি করার কথা ভাবত সকলে তাহলেও কিঞ্চিৎ পাপস্খলন হতে পারত। আমাদের বর্তমান এখন একদিনের জন্য বাংলা ভাষা প্রেমী হয়ে বাকি এগারো মাস বাংলাকে বেচে দিই বাজারের কাছে।একবারও ভাবি না এই পাপ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও গ্রাস করছে আমাদের।
তবে এখনও আশার কথা একটাই ভারতে ২০১১ ‘র জনগণনা রিপোর্ট বলছে, জনসংখ্যার প্রায় ৪৩.৬৩ শতাংশ হিন্দিতে কথা বলে এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার ভাষা কিন্তু বাংলা।
যদিও একটা ভাষা তো বেঁচে থাকে এবং সমৃদ্ধ হয় বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ আহরণ করেই।মনে হতে পারে, প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গে যখন হাজার হাজার বাংলা বই প্রকাশিত হচ্ছে, তখন এর মৃত্যু নেই নিশ্চয়ই।কিন্তু বই গুলো কি প্রসব করছে?ভাষার বুনিয়াদ কিসের ওপর দাঁড়িয়ে এর বিচার করবে কে? মৃত্যু না হলেও সে যে ক্রমশ রক্তহীন হচ্ছে, এই ব্যাপার গুলোর দিকে একটু সজাগ দৃষ্টি দিলেই তা টের পাওয়া যায়।
যে মাতৃভাষার আন্দোলনের হাত ধরে বাংলাদেশ প্রস্ফুটিত হয়েছে , যে আন্দোলনের হাত ধরে সারা বিশ্ব ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পেয়েছে, সেই ভাষা নিয়ে সেই দেশবাসীর চূড়ান্ত আবেগ এবং গভীর ভালবাসা সেটাই তার অবশ্যম্ভাবী স্বাভাবিকতা।শহীদ হয়ে ছিলেন যেমন আব্দুল, জব্বার তেমন এই আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার কথা না বললেই নয়। এরাই বাংলাদেশের মণিমুক্তা।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে বিতর্ক উঠলে সেদিন ছাত্রীরা পক্ষে মত দিয়েছিল। সেদিন সকাল থেকেই বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমতলার সভায় যোগ দিতে এসেছিল। পুলিশি হামলার আশঙ্কায় ছাত্রীদের মিছিল না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিছিলে নারীরা হেঁটেছিল, ছিল অগ্রবাহিনী হিসেবে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে নৃশংসতার প্রতিবাদে অভয়দাশ লেনে নেতৃত্ব দেন বেগম সুফিয়া কামাল ও নুরজাহান মুরশিদ। ধর্মঘট উপলক্ষে প্রচুর পোস্টার ও ব্যানার লেখার দায়িত্ব পালন করেন ড. সাফিয়া খাতুন ও নাদিরা চৌধুরী।ঢাকার বাইরে নারীরা ভাষা আন্দোলনে একাত্ম হতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের শরিক
অনেকের নাম হয়তো ভুলে যেতে বসেছি। একুশ মানে মাথা নত না করা। ভাষা আন্দোলনের অমর সেই সব নারীদের কথা জানা যায় জুবেল আরা জুয়েলের একটি লেখা থেকে।
অপর দিকে, পশ্চিমবঙ্গর এমন কোনও ইতিহাস নেই। কোনও রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে হয় নি। রাজ্যবাসীদের কাছে বাংলাভাষা অনেকটাই যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। তাই তাকে নিয়ে কোন বিশেষ আবেগ নেই আমাদের।বরং যা রয়েছে তা হল কিছুটা অবজ্ঞা মিশ্রিত অবহেলা।বাংলা ভাষা এখানে টেকেন ফর গ্রান্টেড।
যে ভাষাটির জন্ম ও চর্চা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে,যে ভাষা বাঙালিদের বিপুল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক – সেই ভাষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গবাসীর উদাসীন থাকার দিন বোধহয় শেষ নাহলে বিপন্ন হবে তাঁদের অস্তিত্ব।
গাইতে হবে আমাদের,”আমার ভাই এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।”
যা শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয় প্রতিটি বাঙালির দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে। এক শৃঙ্খল মুক্তির গান।