আবছায়া
শাশ্বতী বসাক
দুপুরে যখন সবুজ, কমলা আর কমলাসবুজ মাখানো কমলালেবু কিনতে গিয়ে ফলওয়ালার সাথে দরকষাকষির দড়ি
টানাটানি খেলি, তখন অনাবশ্যকভাবে বাবা এসে দাঁড়ায় চোখের সামনে। গানের ওপারের মতো নির্ভুল আঙুল দিয়ে চিনিয়ে
দেয়, ইটা রসালো, ওটা নিস্ না । এটার খোসা পাতলা হবে, এই লেবু বেশি মিষ্টি। আমি থামিয়ে দিই—চুপ করো, তোমার
সাথে এই হাটের মাঝে, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক ভাবে যদি বকে যাই, লোকে পাগল ভাববে। তোমার দেওয়া ‘পাগলি’
নাম সার্থক ক’রে, আমি নিজে নিজে মেয়েবেলার নির্জন দুপুরে ফিরে যাই। যেখানে বার্ষিক পরীক্ষার পর শীতের
রবিবারগুলো কমলালেবু আর গুড়ের সন্দেশের গন্ধে অন্যরকম হতো। সেখানে লেপের মধ্যে ঢুকে পরেও লুকোচুরি খেলা
চলত দুপুরভর। তারপর মায়ের বকুনিতে ঘুম। শীতঘুমের সেই দুপুরবেলারা কেমন হারিয়ে যায় বড় হলে। বড় হলে সেই
আল্হাদের মানুষরা হাওয়ামানুষ হয়ে যায়। মাথার মুকুটে পালক যোগ হয় ঠিকই, কিন্তু পালকের রঙিন বর্ণ ধীরে ধীরে আবছা
হয়ে আসে। ধূসর হবার আগে আমরা টের পাই না, এই যা তফাৎ!
সময় গড়গড়িয়ে এগিয়ে যায়। আমরা গড়াতে গড়াতে, ধুলোবালি মাখতে মাখতে, স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে, মেমোরি গেম
খেলতে খেলতে সময়ের সাথে এক্কাদোক্কা খেলি। এই খেলার সবথেকে ভালো ক্যানভাস শীতের দুপুর। গায়ে রোদ আর
গরমজামা মেখে আমাদের উষ্ণ সময়রা পাশে এসে দাঁড়ায়। কফি শপের গরম কফি গলার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়,
উষ্ণতাকে ধরে রাখো। তাপ বিকিরণ প্রক্রিয়ার কথা বলে যায়। হঠাৎ করে চোখে পড়ে, উল্টোদিকের টেবিলে চিরকালের
হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধুর অবিকল আবছায়া। কফি গলায় আটকে যায় । গলার ভিতরে জমাট বাঁধা কান্নার অবাক হয়ে দেখে
বন্ধুটি এসে বিপসেছে তার প্রেমিকার সাথে। বছর কুড়ির সেই ছেলেটিও বিস্মিত হয়ে দেখে, মধ্যবয়সী এই মহিলা তার দিকে
এমন মায়াময়, মেদুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেন?
উত্তর জানা নেই। জীবনও অগুনতি প্রশ্ন করে চলে। বাবার হারিয়ে যাওয়া হাত, বন্ধুর হারিয়ে যাওয়া অবয়ব আবছা হতে
গিয়েও শীতার্ত করে না আর, এই বোধ ক্রমেই আশ্বাস দেয়, সামনের বছরেও শীত আসবে। ভাগ্যিস!